বিদেশি ঋণ বেড়ে ১১২ বিলিয়ন ডলার

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ আরও বেড়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। মার্চ শেষে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১০৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। তিন মাসে ঋণ বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুন শেষে ঋণ ছিল ১০৩ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে প্রায় ৮১ বিলিয়ন ডলার। আর বর্তমান সরকারের মাত্র এক বছরে ঋণ বেড়েছে ৮ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার।


বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সচল রাখতে বাংলাদেশ সরকার গত জুনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এআইআইবি, জাইকা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পেয়েছে। এসব নতুন ঋণ যুক্ত হওয়ায় মোট বৈদেশিক ঋণও বেড়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। এতে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২২ টাকায় পৌঁছে যায়। এর ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে। এ সংকট মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে।

তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর রিজার্ভ পতন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। ডলারের বিনিময় হারেও স্থিতিশীলতা দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক ঋণ পাওয়াই এ স্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ।

চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে, তবে বেসরকারি খাতে কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণ ছিল ৮৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার, যা জুনে বেড়ে ৯২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়; অর্থাৎ তিন মাসে সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ৭ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার।

অন্যদিকে, জুন শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে, যা মার্চে ছিল ১৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও একই সময়ে বেসরকারি খাতে সাত কোটি ডলারের বেশি স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে, অন্যান্য বাণিজ্যিক ঋণের চেয়ে পরিশোধের পরিমাণ বেশি হওয়ায় মোট স্থিতি কমে গেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বৈদেশিক ঋণের বেশিরভাগই সরকারের নেওয়া। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ প্রয়োজন হয়। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, অতীতে এ ধরনের ঋণের অপচয় হয়েছে। এমনটা বন্ধ না হলে ঋণের যথাযথ ব্যবহার হবে না, আর ব্যবহার না হলে পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে পড়বে। তবে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে পরিশোধ সক্ষমতাও তৈরি হবে।

তিনি আরও বলেন, জিডিপি অনুপাতে এখনো বৈদেশিক ঋণ সহনীয় পর্যায়ে আছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তুলনায় ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধের অঙ্ক অনেক বেড়ে গেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক মনে হলেও, ঋণ পরিশোধের সময় চাপে পড়তে হতে পারে।

গত কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতিবিদরা বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এসব পরামর্শ উপেক্ষা করে বিদেশি ঋণ বাড়িয়েছিল।

২০০৬ সাল শেষে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে ঋণ বেড়ে ২০০৮ সালের শেষে দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরবর্তী পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ ৩৯ শতাংশ বেড়ে ২০১৩ সালের শেষে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে।

২০১৪ সালে আবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরবর্তী পাঁচ বছরে (২০১৪-১৮) ঋণ দ্রুত বাড়ে এবং ২০১৮ সালের শেষে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার।

টানা তৃতীয় মেয়াদে (২০১৯-২৩) আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ঋণ দাঁড়ায় ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারে। ২০২৪ সালের শুরুতে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ছয় মাসে আরও প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেয় সরকার। সরকারের পতনের সময় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১০৩ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার।

এবি/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
যুবশক্তির কেন্দ্রীয় নেতা নাহিদের পদত্যাগ Dec 20, 2025
img
পুরোনো একটি চিহ্নিত মহল দেশকে নৈরাজ্যের পথে ধাবিত করতে চায় : মির্জা ফখরুল Dec 20, 2025
img
ভারত আর আওয়ামী লীগ নির্বাচন বানচাল করতে চায় : হাদির বোন মাসুমা Dec 20, 2025
img
আইনজীবী আলিফ হত্যায় সাদা টি-শার্ট পরে অংশ নেওয়া সুকান্ত গ্রেপ্তার Dec 20, 2025
img
ইলিয়াসের ফেসবুক বন্ধ করল মেটা Dec 20, 2025
img
হাদির লড়াই ছিল গড়ার, পুড়িয়ে ফেলার নয় : তাসনিম জারা Dec 20, 2025
img
হাসিনাকে আশ্রয় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, জানাল ভারত Dec 19, 2025
img
হাদির খুনিদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতেই হবে : টুকু Dec 19, 2025
img
সকালে ফোন দেখেন না কারিনা! প্রথম চুমুক দেন কোন পানীয়তে? Dec 19, 2025
img
ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক ছাত্র-জনতার Dec 19, 2025
img
‘আমিও একটা মানুষ’, বাবার মৃত্যুশোকে কাহিল ঈশা! Dec 19, 2025
img
ওসমান হাদির মৃত্যুতে ফ্রান্স দূতাবাসের বিবৃতি Dec 19, 2025
img
ভালো-মন্দের বোধ রাখা জরুরি, নাম হলেই সব ভুলে যায় মানুষ: রঞ্জিত মল্লিক Dec 19, 2025
img
নির্বাচনে জিতলে জাতীয় সরকার গঠন করবে জামায়াত : ডা. শফিকুর রহমান Dec 19, 2025
img
চলছে ‘রাক্ষস’-এর শুট, বাংলাদেশে টলিউডের সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়! Dec 19, 2025
img
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক দল ঘোষণা করল শ্রীলঙ্কা Dec 19, 2025
img
আবারও ফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও পাকিস্তান Dec 19, 2025
img
ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড গোটা জাতির অনুভূতিকে নাড়া দিয়েছে : সালাহউদ্দিন Dec 19, 2025
img
আরিয়ানের সিরিজ়ে গালিগালাজ নিয়ে সরাসরি আপত্তি জানালেন মনোজ পাহওয়া Dec 19, 2025
img
৫১৫ রানের অবিশ্বাস্য ম্যাচে ইতিহাস গড়ে জিতল ব্রিসবেন Dec 19, 2025