ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদের হার ও লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৪.২ শতাংশ থেকে নেমে ৪ শতাংশে এসেছে যা গত এক দশকের মধ্যে অন্যতম নিম্নস্তর।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, ঋণ সংকট, ব্যাংক খাতের অস্থিরতা ও বিনিয়োগে অনীহা অর্থনীতির গতি মন্থর করেছে। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও কমে যায়।
বিশ্বব্যাংক বলছে, উচ্চ সুদের হার ও অনিশ্চিত মুদ্রানীতি ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহ করেছে। এর ফলে বিনিয়োগ স্থবিরতা সার্বিক প্রবৃদ্ধিকে টেনে নামিয়েছে।
তবে কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮.৮ শতাংশ, বিশেষ করে তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিক ও কৃষিপণ্যে। একই সময়ে প্রবাস আয় ২৬.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ইতিহাসের অন্যতম উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা অর্থনীতিকে আংশিকভাবে স্থিতিশীল রেখেছে।
কৃষি খাত কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও শিল্প, নির্মাণ ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে— শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৬০.৯ থেকে নেমে ৫৮.৯ শতাংশে এসেছে; বেকারত্ব বেড়ে ৩.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংক খাতের দুর্বলতাও প্রবল হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৪.১ শতাংশে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের তিন গুণ। মূলধন-ঝুঁকি অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৩ শতাংশে। সরকার ইতিমধ্যে ‘ব্যাংক রেজোল্যুশন অধ্যাদেশ’ জারি করে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
বহিঃখাতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে আট বছর পর প্রথমবার চলতি হিসাব উদ্বৃত্তে এসেছে ১৪৯ মিলিয়ন ডলার। তবে যন্ত্রপাতি ও মূলধনী পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় ভবিষ্যৎ বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
রাজস্ব খাতেও চাপ স্পষ্ট। কর আদায় জিডিপির অনুপাতে ৬.৮ শতাংশে নেমে এসেছে, অন্যদিকে ভর্তুকি ও সুদের ব্যয় বেড়ে বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৪.৭ শতাংশে।
অন্তর্বর্তী সরকার কর সংস্কার ও অনলাইন রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার মতো পদক্ষেপ নিলেও সরকারি ঋণ বাড়ছে। বর্তমানে এর ৩৭ শতাংশ দেশীয় ব্যাংক খাতনির্ভর, এবং ২০২৭ সালের মধ্যে ঋণের অনুপাত জিডিপির ৪১.৭ শতাংশে পৌঁছতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক আশা করছে, ২০২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াবে প্রায় ৪.৮ শতাংশে পৌঁছতে পারে। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও সংস্কার বিলম্বই বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের বড় বাধা হয়ে থাকবে।
সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক জ্যাঁ পেসমে বলেন,
“বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে, কিন্তু এটিকে স্বাভাবিক ধরে নেওয়া যাবে না। প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে কর আদায় বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতের সংস্কার, জ্বালানি ভর্তুকি হ্রাস ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন জরুরি।”
এমকে/টিকে