জিল্লুর রহমানের বিশ্লেষণ

রাজনীতিতে আবারও নতুন নাটক শুরু

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও উপস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চ আবারও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা তৈরি হয়েছে গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঁচ দফা সংলাপ শেষ হয়েছে। তবে কবে, কিভাবে এবং কোন আইনি রাস্তায় গণভোট হবে তা নিয়ে দলগুলোর অবস্থান এখনো অটল।

বিএনপি বলছে, জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট হওয়া উচিত, যাতে প্রশাসনিক ব্যয় কম হয় এবং নির্বাচনের ক্যালেন্ডার পিছিয়ে না যায়। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি চাইছে, নির্বাচনের আগে সনদের আইনি বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হোক, যাতে সংসদের গঠন ও ক্ষমতার সীমা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব না থাকে। কমিশনও ইঙ্গিত দিয়েছে যে, বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে অধ্যাদেশ বা অর্ডিনেন্স জারি করে গণভোট আয়োজন করা সম্ভবত বাস্তবসম্মত পথ।

শুক্রবার (১০ অক্টোবর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে জিল্লুর রহমান এসব কথা বলেন।

জিল্লুর রহমান বলেন, সমস্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো রাজনৈতিক অর্থনীতি, কেবল ক্যালেন্ডার নয়। যে দিন গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, মূল প্রশ্ন হলো—জুলাই সনদের কোন অংশে ঐকমত্য আছে এবং কোন অংশে ভিন্ন মত রয়েছে? আর ভোটারকে কি তা পরিষ্কারভাবে জানানো সম্ভব হবে? তবে বড় প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক দলগুলো যদি একমত হয়, তাতেও ব্যক্তি হিসেবে আমি বা আপনি সেই জায়গায় সহমত প্রকাশ করব কি না—তার কোনো গ্যারান্টি নেই। জুলাই সনদে বহু বিষয় থাকবে; সব বিষয়ে একমত হওয়া নিশ্চয় নয়।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের কৌশলও আলাদা।

বিএনপি বলছে একদিনে দুই ভোট নির্বাচন ও গণভোট হলে সম্ভবত সবচেয়ে সুবিধাজনক। অন্যদিকে, জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচনের আগে গণভোট চাচ্ছে কারণ নতুন সংসদকে কনস্টিটুয়েন্ট ক্ষমতা দিতে হলে সনদের বৈধতা আগে নিশ্চিত করতে হবে।

জিল্লুর রহমান বলেন, জুলাই সনদের জটিল রাজনৈতিক আইনে বিতর্ক চলতেই ‘সেফ এক্সিট’ ইস্যু হঠাৎ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্য, অনেক উপদেষ্টা বিভিন্ন দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে নির্বাচনের পর নিজেদের নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করতে চাইছেন। তার এই মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়াাঁ হাসান সরাসরি বলেছেন, এই ধরনের দাবি যিনি করেছেন, তাকে প্রমাণ করতে হবে। তিনি নিজে কোনো এক্সিট খুঁজছেন না এবং বাংলাদেশেই থাকবেন বলে জানান।

জিল্লুর রহমান আরো বলেন, উত্তরাঞ্চল এনসিপি সংগঠক সারজিস আলমও সেফ এক্সিট প্রসঙ্গ রাজনৈতিক মাঠে ছুড়ে দিয়েছেন। সরকারের দায়বদ্ধতার রাজনীতিতে এই মন্তব্যগুলো নতুন চাপ তৈরি করেছে, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ক্যালেন্ডারের প্রেক্ষাপটে। এখন প্রশ্ন হলো, এই এক্সিট বিতর্ক কি জুলাই সনদের ট্র্যাক থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিচ্ছে?

তিনি বলেন, গত এক বছরে গড়ে ওঠা ন্যায়, পুনর্মিলন ও সংস্কারের তিনটি মূল রূপরেখার কেন্দ্রবিন্দু ছিল স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ। উপদেষ্টাদের নৈতিক অধিকার আসে রাজপথে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে অর্জিত প্রত্যাশা রক্ষার দায় থেকে। যদি কোনো রাজনৈতিক ইনসাইডার খেলা হয়, তা গণভোটের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই অভিযোগকারীকে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে, আর অভিযুক্তকে স্বচ্ছতা দেখাতে হবে। নইলে সেফ এক্সিট নিয়ে যে ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে, তা ভোটারের আস্থা ও সমতা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

তিনি আরো বলেন, কমিশনের কাজ কেবল টেকনিক্যাল ডিজাইন নয় বরং বিশ্বাসের অবকাঠামো গড়ে তোলা। আইন ও প্রশাসনের দিক থেকেও কিছু ‘ডু অ্যান্ড ডোন্ট’ পরিষ্কার হওয়া জরুরি। উদাহরণস্বরূপ:

অর্ডিনেন্স → রেফারেন্ডাম → কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার রূপরেখা স্পষ্টভাবে গেজেটে প্রকাশ করতে হবে।

রেফারেন্ডামের দুটি প্রশ্নের—একটি ঐকমত্য প্যাকেজ, অন্যটি ভিন্নমত প্যাকেজ—বাউন্ডারি নির্ধারণ করতে হবে। কোন পাস হলে সংসদ ন্যূনতম বাধ্যতামূলক অবস্থায় থাকবে তা স্পষ্ট করা জরুরি।

নির্বাচনের দিন তারিখ অনির্দিষ্ট রেখে প্রশাসনিক প্রস্তুতি—পোলিং, ট্রেনিং, ব্যালট লজিস্টিক—ডাবল ট্র্যাক করা সম্ভব কি না তা পরীক্ষা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী রেফারেন্ডামের ন্যূনতম ভোটার তথ্য, সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকা, ওয়েব ব্যালট টেস্টিং ও সচেতন প্রচার নিশ্চিত করতে হবে।

জিল্লুর রহমান বলেন, বিকল্পভাবে, যদি গণভোটের পথ অনুসরণ করা হয়, ফলাফল বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট সংক্রান্ত বিষয় উপদেষ্টাদের তাদের অফিস বা পাবলিক ফান্ডের প্রকল্প নিয়ে স্বাধীন অডিট বাধ্যতামূলক। অভিযোগ থাকলে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান, না থাকলে প্রকাশ্য ক্লিয়ারেন্স উভয় অবস্থাতেই আস্থা বজায় রাখার কৌশল তৈরি করতে হবে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির রাজনৈতিক হোমওয়ার্ক স্পষ্ট। একদিনে গণভোট ও নির্বাচন করলে বিএনপির জন্য ঝুঁকি কম, তবে সেক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটির বাধ্যতামূলক ক্ষমতা, ন্যূনতম পিআর উপাদান এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।

তিনি বলেন, জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচনের আগে গণভোট চাইছে যাতে নতুন সংসদকে কনস্টিটুয়েন্ট ক্ষমতা দেওয়া যায়। প্রশাসনিক প্রস্তুতি, ভোটার শিক্ষা এবং বিরোধী শিবিরের ন্যারেটিভ ম্যানেজমেন্ট না হলে লিগাল কারেকশন রাজনৈতিকভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যে পথই নেওয়া হোক, সংকেত একটাই—সনদের ৮৪ প্রস্তাব স্পিরিটসহ বাস্তবায়নযোগ্য কি না, তা গণভোট ও পরবর্তী সংসদের প্রথম অধিবেশনে পরীক্ষা হবে।

জিল্লুর রহমান কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।

ডেলিভারি ক্যালেন্ডার (প্রস্তাবিত) :

১৫-১৭ অক্টোবর: স্বাক্ষর
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ: অর্ডিনেন্স
নভেম্বর: নির্বাচনের/গণভোটের দিন নির্ধারণ
ডিসেম্বরে: গ্যাজেটেড শিডিউল অব রিফর্মস
জানুয়ারি: রুলস অফ প্রসিজার খসড়া
ফেব্রুয়ারি: নির্বাচন

জনগণের আস্থা ফেরাতে তিনটি ধাপ জরুরি :

১. উপদেষ্টাদের সম্পদ ঘোষণা ও অফিশিয়াল লিয়াজোঁ প্রোটোকল প্রকাশ
২. কমিশনের মিটিং নোটস ও এক্সপার্ট রিকমেন্ডেশনের সারসংক্ষেপ ওয়েব বা প্রকাশ করা
৩. ইসি ও প্রশাসনের জিরো টলারেন্স—কেসশিট, ভোটের আড়ালে প্রকল্প বরাদ্দ, লাইসেন্স নিয়োগ ইত্যাদিতে স্বচ্ছতা বজায় রাখা

জিল্লুর রহমান বলেন, নাহিদ, রিজওয়ানা, সারজিস—প্রত্যেক পক্ষের প্রুফ অব কনসেপ্ট দেখানো এখন সময়ের দাবি। অভিযোগ করা হলে প্রমাণ দেখাতে হবে, নইলে সেফ এক্সিট বিতর্ক নির্বাচনী আখ্যানের কেন্দ্র দখল করবে, যা কারো জন্যই শুভ নয়।


আইকে/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
পিআরসহ ৫ দফা দাবিতে সিলেটে জামায়াতের গণমিছিল Oct 11, 2025
img
জার্মানদের আক্রমণের ঝড়ে উড়ে গেলো লুক্সেমবার্গ Oct 11, 2025
img
দেশে ফিরেছেন শহিদুল আলম Oct 11, 2025
img
২০২৫ সালে মাত্র চারটি সিনেমা ঢুকেছে ৩০০ কোটির ক্লাবে Oct 11, 2025
img
‘বহুমাত্রিক জ্ঞান-দক্ষতা ছাড়া কেউই দেশ চালাতে পারবে না’ Oct 11, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Oct 11, 2025
সবার জন্য এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে Oct 11, 2025
নির্বাচন সামনে, পিআর নিয়ে জামায়াতের অবস্থান কী? Oct 11, 2025
১০টি বাস পেলো রাবির বিসিএস পরীক্ষার্থীরা! Oct 11, 2025
সংঘর্ষের পর চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেন মেজর রেজাউল করিম Oct 11, 2025
গণতন্ত্র ও শান্তির হাতিয়ার হিসেবে মাচাদোর নেতৃত্ব Oct 11, 2025
রাকসু নির্বাচনের আমেজ নিয়ে যা বললেন ছাত্রদলের এষা Oct 11, 2025
জুতা হাতে সিঁড়ি বেয়ে বৌদ্ধবিহারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা – সৌজন্যের নজির! Oct 11, 2025
থার্ড পার্টি অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেসেজ পাঠানোর অভিযোগ রাবি প্রশাসনের বিরুদ্ধে Oct 11, 2025
কঠিন চীবর দান উপলক্ষে বৌদ্ধ বিহারগুলোতে ভক্তদের ঢল Oct 11, 2025
তুরস্কে পৌঁছেছেন সেই শহিদুল আলম Oct 11, 2025
তিন বছর আগে থেকেই শিবিরে যুক্ত, জানালেন হিন্দু সদস্য! Oct 11, 2025
আশুলিয়ার বৌদ্ধবিহার গিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। Oct 11, 2025
রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হবে: ধর্ম উপদেষ্টা Oct 11, 2025
img
ঐকমত্যের ভিত্তিতে যথাসময়ে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হবে: ধর্ম উপদেষ্টা Oct 11, 2025