মক্কার শেষ উসমানীয় ‘আমীর’ ছিলেন আলী হায়দার পাশা

১৫১৭ সালে সুলতান সেলিম প্রথমের নেতৃত্বে মামলুক সাম্রাজ্য জয় করার পর পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনার ওপর উসমানীয় তুর্কিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকেই স্থানীয় শরিফ (অভিজাত) পরিবারের আনুগত্যের মাধ্যমে প্রায় চার শতাব্দী ধরে হিজাজ অঞ্চলে শাসন চালায় ওসমানীয় খেলাফত।

এই অভিজাত পরিবারগুলো ছিল নবী মুহাম্মদ (সা.)–এর বংশধর—তার দৌহিত্র হাসান ইবনে আলীর বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারী। তাদের বলা হতো হাশেমি বা বনু হাশিম।

ওসমানীয় শাসনের সময় মক্কার অভিজাতরা ইসলামি বিশ্বের সম্মানিত নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তারা শুধু ধর্মীয় মর্যাদাই পাননি, বরং করমুক্তি ও নিজস্ব বাহিনীর মতো রাজনৈতিক সুবিধাও ভোগ করতেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত এই বংশের প্রতিনিধিরাই মক্কার নেতৃত্বে ছিলেন। তাদের মধ্যে শেষজন ছিলেন শরিফ আলী হায়দার পাশা—যিনি তুর্কিদের প্রতি অনুগত থেকে আরব বিদ্রোহ ঠেকানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

তার কাজ ছিল কঠিন কারণ তারই আত্মীয় শরিফ হুসাইন ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন।

যুদ্ধ শেষে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন হয়, খেলাফত বিলুপ্ত হয়, আর ১৯৩৫ সালে লেবাননে নির্বাসনে নিঃস্ব অবস্থায় মৃত্যু হয় আলী হায়দার পাশার।

কিন্তু তার জীবনকে শুধু এই পরিণতিতে সীমাবদ্ধ করলে অন্যায় হবে। তিনি ছিলেন শেষ উসমানীয় খলিফা আবদুলমাজিদ দ্বিতীয়–এর ঘনিষ্ঠ সহচর, সংসদ সদস্য ও এক সময়ের ক্ষমতাধর রাজনীতিক।

উসমানীয় রাজ-দরবারে বেড়ে ওঠা



১৮৬৬ সালে ইস্তাম্বুলে জন্ম নেওয়া আলী হায়দার ছিলেন মক্কার শরিফ (অভিজাত) পরিবারের এক তরুণ উত্তরাধিকারী। ওসমানীয়রা প্রথাগতভাবে মক্কার শরিফ পরিবারের এক সদস্যকে রাজধানীতে রাখতেন একধরনের ‘রাজবন্দি’ হিসেবে, যাতে তাদের আনুগত্য নিশ্চিত থাকে।

তবে আলী হায়দারের বেড়ে ওঠা ছিল রাজকীয়। তিনি ছিলেন ইয়িলদিজ প্রাসাদের রাজকীয় বিদ্যালয়ের একমাত্র অ-রাজপরিবারের ছাত্র। এই ঘনিষ্ঠতার কারণেই তার সঙ্গে রাজপরিবারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, বিশেষ করে শেষ খলিফা আবদুলমাজিদ দ্বিতীয়ের সঙ্গে।

সুলতান আবদুলহামিদ দ্বিতীয় নিজ হাতে আলী হায়দারকে ভবিষ্যতের মক্কার আমির হিসেবে গড়ে তুলছিলেন। কিন্তু ১৯০৯ সালে ইয়ং তুর্ক বিপ্লবের পর সেই পরিকল্পনা শেষ হয়ে যায়।

রাজনীতি ও সংসদে উত্থান

আলী হায়দার ছিলেন শরিফ পরিবারের জাওয়ি যায়েদ শাখার সদস্য, যাদের প্রতি তুর্কিদের বিশেষ আস্থা ছিল। অপরদিকে, শরিফ হুসাইন ছিলেন আউন শাখার যাদের বিদ্রোহী ভাবমূর্তি ছিল।

তুর্কিদের সমর্থনে আলী হায়দার ইস্তাম্বুলে য়াকফ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হন এবং ১৯০৮ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব নেন।

রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি তিনি ভোগ-বিলাসে অভ্যস্ত ছিলেন ইস্তাম্বুলের দুই পাশেই তার প্রাসাদ, গাড়ি, চাকর-বাকর, ব্যক্তিগত শিক্ষক ও বিদেশি অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল।

আরব জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম



প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আলী হায়দার তুর্কিদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। তার ডায়েরিতে তিনি লেখেন ‘আরব জাতীয়তাবাদীদের অহংকার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মনে হয় সমগ্র ইসলামি দুনিয়াই ভেঙে পড়বে।’

১৯১৬ সালে মদিনায় আলী হায়দার পাশা, এই বছর তিনি মক্কার শরীফ হন।

তিনি বিশ্বাস করতেন, আরবদের ভবিষ্যৎ ওসমানীয় খেলাফতের সঙ্গেই যুক্ত থাকতে হবে। যদিও তিনি আরব জাতীয়তাবাদীদের দমননীতির বিরোধিতা করেছিলেন, এমনকি আরবি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবও দেন তবে তুর্কিদের পতনের মুখে এসব সংস্কার আর বাস্তবায়িত হয়নি।

১৯১৬ সালে শরিফ হুসাইন যখন ব্রিটিশদের মিত্র হয়ে আরব বিদ্রোহ শুরু করেন, তখন তুর্কিরা হুসাইনকে পদচ্যুত করে আলী হায়দারকে মক্কার শরিফ নিযুক্ত করে। তিনি মদিনায় পৌঁছে ১৫ হাজার আরব সৈন্যের নেতৃত্ব নেন এবং উপজাতিগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করেন— বিশ্ব যখন অস্থিরতায় ভরা, তখন তোমরা কেন উসমানীয়দের হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। উসমানীয়রা পরাজিত হয়, ব্রিটিশ-ফরাসিরা আরব ভূমি দখল করে নেয়, আর হুসাইনের রাজ্যও পরে সৌদি বাহিনীর হাতে পতিত হয়।

নির্বাসন, নিঃস্বতা ও মৃত্যু

১৯১৮ সালে আলী হায়দার ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন তখন শহরটি ছিল ব্রিটিশ দখলে। ফেরিতে বসে শহর দেখে তিনি লেখেন, হে আল্লাহ, এই সুন্দর দেশটি যেন মুসলমানদের হাতেই থাকে।

তার প্রার্থনা আংশিকভাবে পূরণ হয় তুরস্ক মুক্ত হয়, কিন্তু খেলাফত বিলুপ্ত হয় (১৯২৪) এবং ইসলামি ঐতিহ্য দমন শুরু হয়।

আলী হায়দার পাশা পশ্চিমা পোশাক পরতে অস্বীকার করেন, সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে ঘরবন্দি জীবন বেছে নেন। রাজকীয় ভাতা বন্ধ হয়ে গেলে তাকে নিজের ঘোড়া, গাড়ি ও প্রাসাদের সামগ্রী বিক্রি করতে হয়।

শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৩০-এর দশকে লেবাননের বৈরুতে নির্বাসনে চলে যান। ১৯৩৫ সালে সেখানেই তিনি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার উপাধি, সম্পদ, রাজনৈতিক মর্যাদা কিছুই ছিল না।

উত্তরাধিকার

তার সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ সৌভাগ্যবান ছিলেন। ছেলে আবদুলমাজিদ পরবর্তীতে জর্ডানের রাষ্ট্রদূত হন, অন্যরা ব্যবসায়ী ও শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। আলী হায়দার পাশার দ্বিতীয় স্ত্রী ফাতিমা (পূর্বে ইসাবেল ডান) তার ডায়েরিটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, যা পরবর্তীতে A Prince of Arabia: The Emir Shereef Ali Haider নামে ১৯৪৮ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয়।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই 

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
‘লং মার্চ টু যমুনা’ স্থগিত, এবার নতুন কর্মসূচি দিলেন শিক্ষকরা Oct 16, 2025
img
চাকসু নির্বাচনে বিজয়ীদের ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিলেন ছাত্রদলের নাছির Oct 16, 2025
img
তাজমহলের ‘ডিএনএ টেস্ট’ চান পরেশ রাওয়াল! Oct 16, 2025
img
চাকসুর স্থগিত দুই হলে শুরু হয়েছে ভোট গণনা Oct 16, 2025
img
শোবিজ ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট কাজের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন নিলয় আলমগীর Oct 16, 2025
সড়ক মেরামতে নারী ঠিকাদার খুঁজছে সরকার Oct 16, 2025
img
দেশরক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেনাবাহিনী : চিফ প্রসিকিউটর Oct 16, 2025
img
জুলাই সনদে দলগুলো সই না করলে দেশের আকাশ কালোমেঘে ছেয়ে যাবে: রিজভী Oct 16, 2025
img
বাবা হলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ Oct 16, 2025
img
হানিয়া আমিরকে জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত ঘোষণা Oct 16, 2025
img
র‍্যাবের ওপর হামলা, সিদ্ধিরগঞ্জে গ্রেপ্তার ১ Oct 16, 2025
img
মিডিয়া ছেড়ে দেওয়ায় আমার বরকত বেড়েছে : সানাই মাহবুব Oct 16, 2025
img
নির্দ্বিধায় চালকের পাশে বসে গেলেন অভিনেতা ডা. এজাজ Oct 16, 2025
img
গাজায় ত্রাণ প্রবেশে রাফাহ ক্রসিং খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত ইসরাইলের Oct 16, 2025
img
জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি জামায়াত : গোলাম পরওয়ার Oct 16, 2025
img
সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন দম্পতির বিরুদ্ধে দুদকের দুই মামলা Oct 16, 2025
img
সংসদ ভবন এলাকায় আগামীকাল ড্রোন ওড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা Oct 16, 2025
img
রাকসু নির্বাচন ঘিরে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছাত্রদল প্যানেলের Oct 16, 2025
img
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশ ওয়ানডে স্কোয়াড ঘোষণা Oct 16, 2025
img
ঢামেকে ভুয়া চিকিৎসককে হাতেনাতে ধরলেন রোগীর স্বজনরা Oct 16, 2025