জনগণের দোরগোড়ায় সহজে ভূমি সেবা পৌঁছে দিতে দেশের প্রতিটি জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ে নাগরিক সেবাকেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ।
রোববার (২৬ অক্টোবর) সচিবালয়ে গণমাধ্যম কেন্দ্রে ‘জনবান্ধব ভূমিসেবায় গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ভূমি অফিসে মানুষ অনেক হয়রানির শিকার হন। এজন্য আমরা ভূমি সেবা অনলাইনে করে মানুষের দোরগোড়ায় নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। এ জন্য গত ডিসেম্বর থেকে ৫টি অনলাইনভিত্তিক সেবা চালু করা হয়েছে। এছাড়া সৎ, স্বচ্ছ ভূমি ব্যবস্থাপনা ভূমি মন্ত্রণালয় একা পারবে না। গণমাধ্যমসহ অন্যান্য অংশীদারদের সহায়তা লাগবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএসআরএফ) উদ্যোগে ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অটোমেটেড ল্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এএলএএমএস) আয়োজনে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।
বিএসআরএফের সভাপতি মাসউদুল হকের সভাপতিত্বে সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক উবায়দুল্লাহ বাদল। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ডিকেএমপি ও উন্নয়ন অনুবিভাগ) মো. এমদাদুল হক চৌধুরী।
সিনিয়র সচিব সালেহ আহমেদ বলেন, আমরা ইতোমধ্যে কাজ করেছি। আরও অনেক কাজ বাকি। বড় কাজ হচ্ছে জরিপ। ভূমিসংক্রান্ত মামলার প্রায় ৮০ শতাংশই জরিপকেন্দ্রিক। অভিযোগের তীর আমাদের দিকেই আসে। মানুষ ভূমি অফিসে হয়রানির শিকার হয়— এটা স্বীকার করছি। তাই আমরা ভেবেছি, কীভাবে ঘরে বসে সেবা নিশ্চিত করা যায়। তাহলেই অফিসভিত্তিক হয়রানি কমবে।
ভূমি সচিব বলেন, সিএস জরিপ করতে ৫২ বছর লেগেছিল। এখন জরিপ করতে এত সময় লাগবে না। জোনিং করা হয়েছে। বালু মহলের জন্য আলাদা ইউনিট করা হয়েছে। মনিটরিং করা হচ্ছে। বালু মহল নিয়ে সব অপরাধ বন্ধ না হলেও কমে এসেছে।
তিনি বলেন, সব অভিযোগ ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে আসে। ভূমি সেবার বিভিন্ন পর্যায়ে দালাল রয়েছে। কিন্তু ভূমির সব কাজ ভূমি মন্ত্রণালয় করে না, আইন মন্ত্রণালয়ও করে। বিশেষ করে দলিল, সারাদেশে ভূমিসংক্রান্ত প্রায় ১০ লাখ মামলা রয়েছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার মামলা হয়। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো, এখন আর খারাপ লাগে না।
সিনিয়র সচিব বলেন, নাগরিকের চাওয়া-পাওয়ার অনেকটাই পূরণ হয়েছে। আমরা অনেক কাজ করেছি, তবে এখনো অনেক দূর যেতে হবে। দেশের প্রতিটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নাগরিক সেবা কেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে জনগণ সহজে ভূমি সেবা পেতে পারেন। বর্তমানে সারাদেশে ৮১৭টি ভূমি সেবা সহায়তা কেন্দ্র চালু রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা অ্যাপ চালু করেছি, যার মাধ্যমে পর্চা সংগ্রহ, নকশা পাওয়া, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ— সবই ঘরে বসে করা যায়।
সেমিনারে ডিজিটাল সেবার অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, অটোমেটেড ভূমি সেবার সুফল ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। মানুষ এখন ঘরে বসে ভূমি উন্নয়ন কর দিতে পারছেন। ফলে রাজস্ব আদায় বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৩৭৩ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৮৬ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, ভূমি খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি কমিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক সেবা সহজ করা। এছাড়া ভেন্ডার নির্ভরশীলতা কমানো, ডিজিটাইজ জরিপ করে নির্ভুল তথ্য নিশ্চিত করা ও সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে দুর্নীতি কমিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক সেবা সহজ করা।
অতিরিক্ত সচিব বলেন, ১৬১২২ নম্বর কল সেন্টারের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হচ্ছে— দৈনিক প্রায় আড়াই হাজার কল গ্রহণ করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ভূমি উন্নয়ন কর আদায় বেড়েছে ২২ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এক হাজার ১৫৪ কোটি টাকা ভূমি উন্নয়ন কর আদায় হয়েছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৭৩ কেটি টাকা ভূমি উন্নয়ন কর আদায় হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৮৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নাগরিকরা ২৭ লাখ দাখিলা নিয়েছিলেন। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছর ৩৮ লাখ দাখিলা নিয়েছেন।
তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মিউটেশন আবদন জমা পড়েছে ১৭ লাখ ৭৬ হাজার। গত অর্থবছর একইসময়ে ছিল ১৩ লাখ। খতিয়ান নেওয়ার আবেদন বেড়েছে। তবে সকল খতিয়ান অনলাইন সিস্টেমে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ৬ কোটি খতিয়ান আছে দেশে। হোল্ডিংও সব দেওয়া হয়নি। ভুলভ্রান্তি রয়েছে। এগুলো সমাধানের কাজ চলছে।
অতিরিক্ত সচিব বলেন, প্রজেক্টের মাধ্যমে সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। এখন স্থায়ী কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। আবেদনগুলো জটিল প্রক্রিয়া। অনেক দলিল ও অন্যান্য কাগজপত্র দিতে হয়, নামজারির আবেদন করতে। ভূমিসেবা সহায়তা কেন্দ্রের মাধ্যমে নাগরিকদের সহায়তা করা হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে ভূমিসেবা সহায়তা কেন্দ্রের আবেদন ফি ২৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সারাদেশে ৬১ জেলায় ৮২০টি ভূমিসেবা সহায়তা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
সেমিনারে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, যুগ্ম সচিব ডিকেএমপি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, উপসচিব সেলিম আহমদ, আমজাদ হোসেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিস্টেম অ্যানালিস্ট মোহাম্মদ নূর হোসেন, উপদেষ্টা ও সিনিয়র সচিবের পিএস, এপিএসসহ বিএসআরএফের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আরপি/টিকে