আইন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে একটি দলকে সুবিধা দেয়ার আশ্বাসের অভিযোগ এনসিপির

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ২০ অনুচ্ছেদ সংশোধন নিয়ে একটি দলকে সুবিধা দেয়ার অভিযোগ তুলেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এই দুটি বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চেয়ে আইন উপদেষ্টার কাছে চিঠি দিয়েছে দলটি।

রোববার (২ নভেম্বর) এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের সই করা চিঠিটি আইন উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়।

আইন উপদেষ্টাকে দেয়া চিঠিতে এনসিপি জানায়- সাম্প্রতিক সময়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ২০ অনুচ্ছেদ সংশোধন সংক্রান্ত আলোচনায় একটি রাজনৈতিক দলকে আপনার ব্যক্তিগত আশ্বাস ও অবস্থান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, একজন উপদেষ্টা হিসেবে আপনি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ আইন উপদেষ্টা, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নন। নির্বাচনী আইন সংশোধনের মতো বিষয়ে কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে এককভাবে আশ্বাস প্রদান করা জুলাই গণঅভুথান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পদের নিরপেক্ষতা ও দায়বদ্ধতার পরিপন্থী।

আইন সংশোধনের মতো সিদ্ধান্ত কোনো একক ব্যক্তির নয়। এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক, পরামর্শনির্ভর (consultative) ও জনস্বার্থমূলক প্রক্রিয়া। অতএব সরকারের পক্ষে এমন কোনো আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া যা একটি নির্দিষ্ট দলের দাবির সঙ্গে একমত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়, তা আপনার প্রশাসনের প্রতি জনআস্থাকে দুর্বল করবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষতার ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

একইসাথে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ২০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে আপনি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের বিপরীতে যে অবস্থান নিয়েছেন তা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপন্থী বলে আমরা মনে করি।

প্রথমত, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ব্যবস্থার উদ্দেশ্যই হলো দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, আর্থিক স্বচ্ছতা ও নীতিগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন নিবন্ধিত দল অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচন করে, তখন তারা নিজেদের নিবন্ধনের দায়বদ্ধতা থেকে কার্যত অব্যাহতি পায়। এতে নিবন্ধন প্রক্রিয়ার নিজস্ব অর্থই হারিয়ে যায়। একদিকে দলটি আলাদা পরিচয় দাবি করে, অন্যদিকে নির্বাচনে অন্য দলের প্রতীক ব্যবহার করে। এটি আইনি বৈপরীত্য সৃষ্টি করে, এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতাকে অকার্যকর করে তোলে।

দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি হলো রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা। যে দলের নামে জনগণ ভোট দেন, সেই দলই নির্বাচনের পর জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। কিন্তু যখন একাধিক নিবন্ধিত দল বড় দলের প্রতীকে নির্বাচন করে, তখন ভোটার জানেন না তিনি আসলে কাকে ভোট দিচ্ছেন। ভোটার যে রাজনৈতিক দর্শন, নীতি বা নেতৃত্বকে সমর্থন জানাতে চান, তা অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। এর ফলে ভোটার-দায়বদ্ধতার সম্পর্ক ভেঙে যায়।

তৃতীয়ত, এই বিধান কৃত্রিম বহুদলীয়তা সৃষ্টি করে এবং বড় রাজনৈতিক দলগুলিকে কাঠামোগত সুবিধা দেয়। বড় দলগুলি নিজস্ব স্বার্থে ছোট ছোট 'প্রক্সি দল' তৈরি করে তাদের প্রতীকে নির্বাচন করায়। পরে এই ছোট দলগুলো সংসদে বা বিভিন্ন কমিটিতে কৃত্রিম ভিন্নমত নিয়ে হাজির হয়ে বাস্তবে সেই বড় দলেরই বক্তব্য পুনরাবৃত্তি করে। এতে গণপরিসরে মতের বৈচিত্র্য নষ্ট হয়, 'জাতীয় ঐকমত্য' গঠনের প্রক্রিয়া বিকৃত হয় এবং নির্বাচনের পরবর্তী নীতিনির্ধারণে আর্টিফিশিয়াল বহুমতের জন্ম হয়।

অতএব, আমরা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের অবস্থানের সাথে আমরা একমত যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ২০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন যে কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অন্য কোনো দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না। কোনো যৌথ জোট বা জোটনির্ভর প্রার্থী মনোনয়নের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি নতুন নিবন্ধিত রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিকট নিবন্ধন করতে হবে।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করেন, এমন সংশোধন রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে সংকুচিত করবে না, বরং প্রকৃত গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদকে শক্তিশালী করবে। কারণ এতে প্রতিটি দলকে নিজের নাম, নীতি ও নেতৃত্বের দায় নিজেকেই নিতে হবে। এটি ভোটারের অধিকার, রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতা এবং সাংবিধানিক ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম শর্ত।

চিঠিতে উল্লিখিত দুটি বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার অনুরোধও জানান আখতার।

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
রাজধানীতে ঝটিকা মিছিলে আওয়ামী লীগের ৬ নেতাকর্মী আটক Nov 03, 2025
img
ফের বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে পতন Nov 03, 2025
img
বাংলাদেশ এখন সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে : সিইসি Nov 03, 2025
img
প্রধান ইস্যু এখন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন : জাহেদ উর রহমান Nov 03, 2025
img
জিয়াউর রহমানের পর ইউনূস সরকারই সবচেয়ে সফল : ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ Nov 03, 2025
img
বিএনপির ওয়েবসাইটে বড় পরিবর্তন, দেওয়া যাবে অনুদানও Nov 03, 2025
img
জামায়াতের নির্বাচনী ক্যাম্পেইন ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়ে রুমিন ফারহানার মন্তব্য Nov 03, 2025
img
দেশের তিন বিভাগে বজ্রবৃষ্টির আভাস Nov 03, 2025
img
ভোটের বাজারে এনসিপির কোনো অবস্থান নাই : মাসুদ কামাল Nov 03, 2025
img

বিয়ারিং প্যাড পড়েপথচারী নিহতের ঘটনা

জীবনের মূল্য হিসেবে নয়, তাৎক্ষণিক সাহায্য করা হয়েছে : ডিএমটিসিএল এমডি Nov 03, 2025
img
বিসিবির নতুন পরিচালক রুবাবা দৌলা Nov 03, 2025
img
এআই এখন মেটার উদ্বেগের বড় কারণ Nov 03, 2025
img

তাইওয়ান ইস্যুতে ট্রাম্পের কড়া বার্তা

আমি সবার কাছে সব কিছু বলি না, চীন কিছু করলে পরিণতি হবে ভয়াবহ Nov 03, 2025
img
বিশ্বকাপ জিতে বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন স্মৃতি মান্ধানা Nov 03, 2025
img
ভারতে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ গেল ১৯ জনের Nov 03, 2025
img
খাগড়াছড়িতে ট্রাক উল্টে প্রাণ গেল ১ জনের, আহত ৩ Nov 03, 2025
img
এবার ফ্যান্টাসি অ্যাডভেঞ্চারে কার্তিক আরিয়ান Nov 03, 2025
img
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় সাক্ষীদের দ্বিতীয় দিনের জেরা আজ Nov 03, 2025
img
তেহরানের পানিসংকট, ২ সপ্তাহেই শুকিয়ে যেতে পারে প্রধান জলাধার Nov 03, 2025
img
টেস্ট প্রস্তুতির জন্য টি-টোয়েন্টি দল ছাড়লেন ট্রাভিস হেড ও কুলদিপ Nov 03, 2025