নারী ক্রিকেটে গ্রুপিং নিয়ে তীব্র সমালোচনায় জাহানারা আলম

বাংলাদেশ নারী দলের ড্রেসিংরুমে গ্রুপিং, সিন্ডিকেটসহ নানা ধরনের অনিয়মের কথা এতদিন কেবল শোনা গেছে। এবার প্রকাশ্যে একগাদা অভিযোগ আনলেন সাবেক টাইগ্রেস পেসার জাহানারা আলম।

একসময় জাতীয় দলের নিয়মিত মুখ ছিলেন জাহানারা আলম। দেশের একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাহানারা জানিয়েছেন, জাতীয় দলের অভ্যন্তরের নানা ঘটনার কথা। যা শুনলে যে কারও চোখ কপালে উঠে যাবে। বাংলাদেশ দলের বর্তমান অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতির বিরুদ্ধে মারধরের মত গুরুতর অভিযোগও এনেছেন জাহানারা।

দেশের একটি গণমাধ্যমকে জাহানারা জানিয়েছেন, ‘আসলে আমি একা নই, বাংলাদেশ দলের সবাই কমবেশি ভুক্তভোগী। যার যার ভোগান্তির জায়গাটা ভিন্ন। এখানে উন্নত সুযোগ-সুবিধা দু-একজন পায় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধু একজনই পায়। ২০২১ সালে করোনা-পরবর্তী ক্যাম্প থেকে আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমার মতো সিনিয়রকে নিধন কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর বাংলাদেশ গেমসে তিনটি দলের একটির অধিনায়ক করা হয় আমাকে। অন্য দুটি দলের অধিনায়ক ছিল জ্যোতি (বর্তমান জাতীয় দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা) ও শারমিন সুলতানা। সিনিয়রদের ওপর চাপের শুরু তখন থেকেই।’

জাহানারা আরও বলেছেন, ‘আমার দল কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাদেশ গেমসের ফাইনালের পর থেকে শুরু হয় আমার সঙ্গে মঞ্জু ভাইয়ের (নারী দলের সাবেক নির্বাচক ও ম্যানেজার মঞ্জুরুল ইসলাম) দুর্ব্যবহার, অপমান ও টিজিং। তখন থেকে মঞ্জু ভাই ও তৌহিদ ভাই (বিসিবির নারী ক্রিকেট বিভাগের সাবেক ইনচার্জ প্রয়াত তৌহিদুর রহমান) আমার ফোন ধরতেন না। উনারা দুজন আমাকে নিয়মিত অপমান করতে শুরু করেন।’



মঞ্জু এবং তৌহিদের আচরণ প্রসঙ্গে জাহানারা আরও জানান, ‘তারা চাইছিলেন আমি যেন হারিয়ে যাই। ২০২৩ সাল পর্যন্ত ওভাবেই চলছিল। বিকেএসপিতে দল নির্বাচনের অনুশীলন ম্যাচে গিয়ে দেখি আমার সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ। পরে জানতে পারি, মঞ্জু ভাই ও তৌহিদ ভাইয়ের সরাসরি নির্দেশনা ছিল আমাকে কিছু না দেওয়ার। যে সফরে বাদ পড়লাম, তার আগে থেকে জ্যোতিও আমার সঙ্গে কথা বলে না। শুধু জ্যোতি নয়, অনেক খেলোয়াড়ই তখন আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক দিন পর ওরা আবার কথা বলতে এলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এখন কেন কথা বলছ?” ওরা জবাব দিয়েছিল, “আপনার সঙ্গে কথা বলায় নিষেধ ছিল জ্যোতি আপুর।”’

এসবের মাঝেই ২০২৩ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়া প্রসঙ্গে জাহানারা জানান, ‘হ্যাঁ, সৌভাগ্যক্রমে (সুযোগ পেয়েছিলাম)। বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কা সফরেও গেলাম। সেখান থেকে এসে কোনো কারণ ছাড়া আবার বাদ পড়লাম। ২০২৩ সালের অক্টোবরে এশিয়ান গেমসের প্রিলিমিনারি ক্যাম্পে দেখি ২৫ জনের দলেও আমি নেই। তখন একদিন ঘটনাচক্রে পাপন স্যারের (সাবেক বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান) সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়। তখন উনার নির্দেশনা ছিল, “২৬ নম্বর খেলোয়াড় হয়ে তুমি ক্যাম্পে যাবে।”’

সেই ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা প্রীতিকর ছিল কিনা এমন প্রসঙ্গে জাহানারা জানিয়েছেন, ‘একদম না। কোচ কথা বলেন না। কথা বলেন না ভিডিও অ্যানালিস্ট রাশেদ স্যারও (রাশেদ ইকবাল)। উনার কাজ কী? সবার পারফরম্যান্সের ভিডিও উনার কাছে থাকবে, এই তো? কিন্তু আমি আমার ভিডিও নিয়ে কাজ করতে চাইলে উনার কথা, “তোর কোনো ফুটেজ আমার কাছে নেই।” শ্রীলঙ্কা সফরে খুব বাজেভাবে হারার পর টিম মিটিংয়ে তিনি আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপমানও করেছিলেন।’

রাশেদের এমন করার কারণ প্রসঙ্গে জাহানারা বলেছেন, ‘তিনি বিকেএসপিতে লম্বা সময় কাজ করেছেন, সে জন্যই হয়তো ওই প্রতিষ্ঠানের খেলোয়াড়দের টানতেন তিনি। তত দিনে দলে বিকেএসপির তিনজন পেসার - মারুফা আক্তার, দিশা বিশ্বাস ও ফারিহা (ইসলাম) তৃষ্ণা। আমার কথা হলো, ওদের টানতে গিয়ে তো আমাকে মানসিক চাপে ফেলার দরকার নেই!’

টাইগ্রেস পেসার আরও জানান, ‘আপনি যদি মনে করেন, এখানে দু-একজনের দোষ, সেটি ভুল। অনেক বড় একটি সিন্ডিকেট এখানে অনেক আগে থেকেই সক্রিয়, যা তৈরি করেছেন মঞ্জু ভাই ও তৌহিদ ভাই। মেয়েদের দলের পুরো ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখার জন্য জ্যোতিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে অধিনায়কত্বে নিয়ে আসেন তারা।’

ক্ষমতার অপব্যবহারের উদাহরণ দিতে গিয়ে জ্যোতি জানিয়েছেন, ‘২৬তম সদস্য হয়ে ক্যাম্পে যাওয়ার কথা বলেছিলাম না? ওই ক্যাম্পে আমাকে কোনো টি-শার্ট পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অথচ ফিটনেস টেস্টে সেরা তিনে থাকলাম। ফিল্ডিংয়েও প্রথম সারিতে আমি। তবু দুই সপ্তাহ ক্যাম্প করার পর বাড়ি পাঠিয়ে দিল। আমি যে বাদ পড়ব, আগে থেকেই ‘ফিক্সড’ ছিল। (ফিক্স করার কাজটা) প্রথমে নাহিদা (আক্তার) এবং রিতু মনি পরিকল্পনা করে। এরা যদি মনে করে কাউকে ‘সাইজ’ করতে হবে, তখন জ্যোতির সঙ্গে আলোচনা করে। জ্যোতির আবার আলাদা একটি গ্রুপ। ওর সঙ্গে আছে পিংকি (ফারজানা হক) ও ইশমা (তানজিম)। রাবেয়া (খান) ওর ডান হাত। এখন সুমাইয়া(আক্তার)ও যোগ হয়েছে। এই হচ্ছে জ্যোতির প্যানেল। এরা যে কী করতে পারে, আপনার কোনো ধারণাই নেই। পুরো ক্রিকেটটাকে এরা ধ্বংস করে দিচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর পরিবেশটা ওরা রাখছে না। সিলেটে হওয়া একটি ক্যাম্পের কথা বলতে চাই।’

জাহানারা আরও বলেন, ‘সিলেটে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের ফিটনেস সেশন করার পর কেউ যখন ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না, তখন দেখি এক জুনিয়র জ্যোতির কিটব্যাগ টেনে এক মাঠ থেকে আরেক মাঠে নিচ্ছে। জুনিয়ররাই সব সময় ওর কিটব্যাগ টানে। কতবার যে জ্যোতিকে বলতে শুনেছি, “এই বসে আছিস কেন? যা আমার ব্যাগ নামা।” জুনিয়ররা আসলে করতে বাধ্য, কিছু করার নেই। সিলেটেরই আরেকটি ঘটনা বলি। দুটি ড্রেসিংরুমের একটি জুনিয়রদের জন্য বরাদ্দ। জ্যোতিকে দেখলাম, ওটায় গিয়ে জুনিয়রদের দিয়ে মাথা টেপাচ্ছে, চুলে তেল দেওয়াচ্ছে।’

ড্রেসিংরুমের বিষাক্ত পরিবেশ নিয়ে জাহানারা আরও বলেছেন, ‘এখন ড্রেসিংরুমে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা হয় খুব কম। ক্ষমতা পেয়ে জ্যোতিও এর অপব্যবহার শুরু করে। প্রথমে শুরু করে সিনিয়রদের নাম ধরে ডাকা; সালমা (খাতুন) আপুকে ‘সাল্লু’ আর আমাকে ‘এই জাহান’। আমি অবশ্য অবাক হইনি। কারণ জ্যোতি ছোটবেলা থেকেই উল্টোপাল্টা কাজ করত। মারামারি করে হাসপাতালে যাওয়ার রেকর্ডও আছে।’

জ্যোতির মারামারির রেকর্ড নিয়ে জাহানারা জানান, ‘তখন আবাহনীতে খেলত, শরিফার সঙ্গে লেগেছিল। মারামারির এক পর্যায়ে শরিফা ওর তলপেটে লাথি দেওয়ায় সে পড়ে যায়। তাতে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথাও উঠে যায় ওর। এরপর অপারেশন করানো লাগে।’

বিশ্বকাপে জ্যোতির আচরণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা প্রসঙ্গে জাহানারা বলেছেন, ‘এটা তো নতুন কিছু নয়। জ্যোতি প্রচুর মারধর করে জুনিয়রদের। এই বিশ্বকাপের সময়ও জুনিয়ররা আমাকে এ রকম জানিয়েছে, “না বাবা, এটা আর করব না। তাহলে আবার থাপ্পড় খেতে হবে।” কয়েকজনের কাছ থেকে জেনেছি, “কালকে মার খেয়েছি।” দুবাই সফরের সময়ও এক জুনিয়রকে রুমে ডেকে নিয়ে থাপ্পড় মেরেছে।’

বাড়তি সুবিধা পাওয়া একজন জ্যোতি কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জাহানারা বলেছেন, ‘আর কে? জ্যোতি তো অনেক সময় ফিটনেস টেস্টই দেয় না। ফিটনেস সেশনও করে না। সহকারী কোচকে (নাসিরুদ্দিন ফারুক) নিয়ে ব্যাটিং অনুশীলন করে বেশি। একজন আরেকজনকে ‘ব্যাকিং’ দেয়।’

দল থেকে জান্নাতুল সুমনার বাদ পড়া নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। সেখানে জ্যোতির হাত আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জাহানারা জানালেন, ‘ইউটিউবে তো খেলা দেখা যায়। আমি দেখিও। দেখে সুমনাকে বাদ পড়ার মতো পারফরমার আমারও মনে হয়নি। তবে অন্য কিছু থাকতে পারে। যেমন - সুমনা খুব ভালো কথা বলতে জানে, মিডিয়া সামলাতে পারে। ভালো পারফরমারও। এখন অধিনায়ক হয়তো মনে করে থাকতে পারে যে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সুমনা ওর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে।’

এসব সমস্যার প্রতিকার চান কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জাহানারা বলেছেন, ‘আগের বোর্ড থাকলেও এত কথা বলতাম না। এখন বললাম, কারণ রাজ্জাক ভাইকে (আবদুর রাজ্জাক, বর্তমানে বিসিবি পরিচালক এবং নারী ক্রিকেট বিভাগের প্রধান) ভালো মানুষ মনে করি। আশা করি, তিনি সবকিছুর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন এবং ভালো একটি পরিবেশ নিশ্চিত করবেন।’

এসএস/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের ব্যাখ্যা দিল সরকার Nov 05, 2025
img

নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী

ড. ইউনূসের সঙ্গে ডিল করে ক্ষমতায় গেলে এনসিপির হাতে বিএনপির পতন হবে Nov 05, 2025
img
জাকির নায়েককে আপাতত বাংলাদেশে আসার অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত Nov 05, 2025
img
রাতে অ্যানফিল্ডে মাঠে নামছে লিভারপুল ও রিয়াল মাদ্রিদ Nov 05, 2025
img
বিপিএলের ৫ দল চূড়ান্ত, থাকছে না বরিশাল Nov 05, 2025
img
আওয়ামী লীগ ফিরবে, সেটা সময়ের ব্যাপার, কিন্তু কীভাবে ফিরবে? Nov 04, 2025
img
মনিরুল হক চৌধুরীকে সর্বোচ্চ ভোটে পাশ করাবো: সাক্কু Nov 04, 2025
img
দুই মাসের মধ্যে সব ক্যাম্পাসে নির্বাচন দিতে হবে: ডাকসু ভিপি Nov 04, 2025
img
বড়দিনে দর্শকের জন্য চমক নিয়ে আসছে কার্তিক-অনন্যা Nov 04, 2025
img
কোহলিকে পেছনে ফেলে নতুন রেকর্ড গড়লেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাটার Nov 04, 2025
img
জন্মদিনে মৌসুমীকে নিয়ে আবেগঘন পোস্ট ওমর সানীর Nov 04, 2025
img
শাহজালালে হচ্ছে অত্যাধুনিক চারতলা কার্গো ভিলেজ Nov 04, 2025
img
যারা নতুন করে রাজনীতি করতে চান, যোগাযোগ করুন : ভিডিও বার্তায় নাহিদ Nov 04, 2025
img
রাশমিকা মান্দানা অবশেষে দেখালেন বাগদানের আংটি Nov 04, 2025
img
কোচ আসলেও এখনো ক্যাম্পে আসেননি কিংসের ফুটবলাররা Nov 04, 2025
img
বিএনপিতে যোগ দিলেন শহীদ মীর মুগ্ধর ভাই স্নিগ্ধ Nov 04, 2025
img
বাংলাদেশের সঙ্গে পাওনা নিয়ে বিরোধ, আন্তর্জাতিক সালিশিতে যাচ্ছে আদানি Nov 04, 2025
img
এনসিপি সরকার গঠন করলে বিএনপিকেও বিচারের সম্মুখীন করা হবে: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী Nov 04, 2025
img
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত Nov 04, 2025
img
নভেম্বরের ৩ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এলো ৩৫ কোটি ডলার Nov 04, 2025