আন্তর্জাতিক মঞ্চে বড়সড় ধাক্কা খেল ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। দুবাই এয়ার শো'তে কসরত বা এরিয়াল ডিসপ্লে দেখাতে গিয়ে ক্র্যাশ করলো ভারতীয় বিমানবাহিনীর গর্ব 'এলসিএ তেজস' (LCA Tejas)। শুক্রবার (২১শে নভেম্বর) দুপুরের এই ঘটনায় স্তম্ভিত গোটা বিশ্ব। যেখানে ভারত তাদের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই যুদ্ধবিমানকে বিশ্বের কাছে বিক্রির জন্য শো-কেস করতে গিয়েছিল, ঠিক সেখানেই হাজার হাজার দর্শকের সামনে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য একটি বড় লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘড়ির কাঁটায় তখন স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ১০ মিনিট। দুবাই এয়ার শো এর শেষ দিনে আকাশে নিজের শক্তি প্রদর্শন করছিল হ্যাল (HAL)-এর তৈরি তেজস মার্ক-১ যুদ্ধবিমানটি। এভিয়েশন সাংবাদিক অঙ্গদ সিং এর তোলা ছবি এবং ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, বিমানটি একটি অত্যন্ত জটিল 'লো-অল্টিচিউড ম্যানুভার' বা মাটির খুব কাছ দিয়ে ওড়ার কসরত দেখাচ্ছিল। রানওয়ের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই পাইলট বিমানটিকে খাড়াভাবে উপরে তোলার চেষ্টা করেন, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তা রানওয়ের অদূরে আছড়ে পড়ে।
ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিমানটি মাটিতে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তেও পাইলট নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ক্র্যাশের সাথে সাথেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ঘটনাস্থল থেকে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশের দিকে উঠতে দেখা যায়।
দুর্ঘটনার ভয়াবহতায় এয়ার শো দেখতে আসা দর্শকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ইন্ডিয়া টুডে'র রিপোর্ট অনুযায়ী, বিস্ফোরণের শব্দে উপস্থিত নারী ও শিশুরা ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। পুরো এলাকা জুড়ে সাইরেন বেজে ওঠে এবং ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো পাইলটের অবস্থা। এনডিটিভি'র বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে ইজেকশনের (Ejection) বা প্যারাসুটের কোনো স্পষ্ট দৃশ্য দেখা যায়নি। অর্থাৎ পাইলট বিমান থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন কি না, তা নিয়ে এখনো গভীর ধোঁয়াশা এবং আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। তবে স্বস্তির খবর হলো, বিমানটি দর্শকদের গ্যালারি থেকে বেশ কিছুটা দূরে ফাঁকা জায়গায় বিধ্বস্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি হয়নি।
এই দুর্ঘটনার টাইমিং বা সময়টা ভারতের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং কিছুটা লজ্জাজনকও বটে। ঠিক গতকালই সোশ্যাল মিডিয়ায় তেজস বিমান থেকে তেল লিক হওয়ার কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারত সরকার এবং পিআইবি (PIB) ফ্যাক্ট চেক টিম তড়িঘড়ি করে জানিয়েছিল যে সেটি কোনো ত্রুটি নয়, বরং সাধারণ একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই সাফাই গাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই, আজ সরাসরি আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও ক্রেতাদের সামনে বিমানটি বিধ্বস্ত হলো।
আন্তর্জাতিক এয়ার শো মূলত এমন একটি জায়গা যেখানে দেশগুলো তাদের সামরিক শক্তি এবং প্রযুক্তির বিজ্ঞাপন দেয়। সেখানে তেজসের মতো একটি 'ফ্লাগশিপ' প্রজেক্ট, যাকে ভারত আর্জেন্টিনা, মিশর এবং ফিলিপাইনের মতো দেশের কাছে বিক্রি করার চেষ্টা করছে তার এই দশা নিঃসন্দেহে ভারতের 'মেক ইন ইন্ডিয়া' এবং প্রতিরক্ষা রপ্তানির স্বপ্নে বড় আঘাত।
এটি তেজস বিমানের ইতিহাসে দ্বিতীয় দুর্ঘটনা। এর আগে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে রাজস্থানের জয়সালমিরে একটি তেজস বিধ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু আজকের ঘটনাটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এটি ঘটেছে বিদেশের মাটিতে, যেখানে চীন এবং পাকিস্তানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোও তাদের যুদ্ধবিমান জে-১০ (J-10) বা জেএফ-১৭ (JF-17) প্রদর্শন করছে। এমন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তেজসের এই ব্যর্থতা ক্রেতা দেশগুলোর মনে আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে।
প্রশ্ন উঠছে রক্ষণাবেক্ষণ এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল নিয়েও। হাজার হাজার কোটি টাকার এই প্রজেক্ট কি তবে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষায় ফেল করলো? সব মিলিয়ে, দুবাইয়ের এই দুর্ঘটনা শুধুই একটি বিমানের ধ্বংস হওয়া নয়, এটি ভারতের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ব্র্যান্ডিংয়ে একটি বড় দাগ। এখন দেখার বিষয়, ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং হ্যাল (HAL) এই বিপর্যয় কাটিয়ে কীভাবে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করে এবং আন্তর্জাতিক মহলে হারানো বিশ্বাস ফেরাতে কী পদক্ষেপ নেয়।
ইএ/টিকে