অর্থনীতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সরকার ব্যবসায়ীদের চিৎকার শুনছে না : বিসিআই সভাপতি

দেশের অর্থনীতি এখন গুরুতর সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতার কারণেই পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ। তাঁর অভিযোগ, ‘দেশের অর্থনীতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে, আমরা যতই চিৎকার করি সরকার শুনছে না, ব্যবসায়ী সমাজের কথা তারা গুরুত্বই দিচ্ছে না।’

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীতে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) কার্যালয়ে মাসিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ এসব কথা বলেন। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান।

সরকার ব্যবসায়ীদের চরম দুরবস্থা দেখেও কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তিনি বিশেষভাবে জ্বালানি সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন, ২০২২ সালের পর থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত উৎপাদন বজায় রাখতে পারছে না। সরকার দাম বাড়ালেও সরবরাহ বাড়েনি।

এই পরিস্থিতি বিশেষ করে ক্ষুুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে।

পারভেজের হিসাব অনুযায়ী, এর মধ্যে ক্ষুদ্র শিল্পের প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেছে। বহু উদ্যোক্তা ব্যবসা ছেড়ে ঢাকায় এসে অটোরিকশা চালাতে শুরু করেছেন। এতে ঢাকার জনসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে এখন সাড়ে তিন কোটিতে দাঁড়িয়েছে।

বিসিআই সভাপতি বলেন, শিল্প খাত এই মুহূর্তে অত্যন্ত চাপে আছে উচ্চ সুদ, মুদ্রাস্ফীতি ও শক্তি সংকট একসঙ্গে কাজ করছে; ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও পড়েছে উল্লেখযোগ্য অনুপাত। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে, শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক করতে ও শিল্প ক্ষেত্রকে বৈচিত্র্যময় করতে সরকারকে আরো উদারনীতি গ্রহণ করতে হবে। নীতিগত কিংবা বাস্তব কোনো পদক্ষেপ না নিলে বর্তমান পরিস্থিতি শ্রমবাজার ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলবে।

শুধু জ্বালানিসংকট নয়, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থাও এখন বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৭ শতাংশ তখন আইএমএফ বাংলাদেশকে ‘মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

এখন খেলাপি ঋণ ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, এ অবস্থায় আইএমএফ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে কোন স্তরে ফেলবে? তিনি সতর্ক করেন, খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকলে ঋণের ব্যয় আরো বাড়বে এবং ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপ আরো বৃদ্ধি পাবে।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে উচ্চ সুদহার, লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, দুর্বল বিনিয়োগ ও ধীর জিডিপি প্রবৃদ্ধির এক দুষ্টচক্রে আটকে গেছে। এই অবস্থায় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশ ১৯৯৭ সালের এশিয়ান আর্থিক সংকট ও ২০০৮-০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দা মোকাবেলায় যে ধরনের নীতি গ্রহণ করেছিল, বাংলাদেশকে এখন সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তাঁর মতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাড়াতে এবং শিল্প খাতকে চাঙ্গা করতে আরো উদার ও ব্যবসাবান্ধব নীতি প্রয়োজন। যদিও পাল্টা শুল্কের কারণে রপ্তানি কিছুটা কমেছে, তবু তিনি মনে করেন যে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় ভালো।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও ব্যাংক খাতের গভীর দুর্বলতার সম্মিলিত চাপে রয়েছে। নীতিগতভাবে সুদের হার বাড়ানো ও তারল্য সংকোচনের কারণে মুদ্রাস্ফীতি কমে ৩৯ মাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে ঠিকই, কিন্তু এই হার আবার বাড়তে পারে।

তাঁর মতে, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, বাজারে ভোক্তা চাহিদার পুনরুদ্ধার এবং সরবরাহব্যবস্থায় সম্ভাব্য বিঘ্ন এই তিন কারণে সামনে মুদ্রাস্ফীতির গতি আবার ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। তিনি জানান, ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক কিছু সংস্কারের কারণে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দুই মাসে আমানতের প্রবৃদ্ধি গড়ে ১০ শতাংশের মতো হয়েছে। এতে মানুষের আস্থা কিছুটা ফিরেছে।

কিন্তু এর বিপরীতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বহু বছরের নিম্নতম পর্যায়ে নেমে গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিলম্বিত করছে। তিনি যন্ত্রপাতি আমদানির তথ্য তুলে ধরে বলেন, নতুন বিনিয়োগের অন্যতম সূচক ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে প্রায় ১১ শতাংশ কমে গেছে, আগের বছর এটি ২০ শতাংশ কমেছিল। এটি স্পষ্ট করে যে শিল্প সম্প্রসারণ কার্যত থমকে আছে।

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
হাদির ঘটনার প্রতিবাদে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ Dec 19, 2025
img
পত্রিকা অফিসে হামলা পরিকল্পিতভাবে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা: সালাহউদ্দিন আহমদ Dec 19, 2025
img
আমি অসংখ্য ফোন করেছি, কিন্তু সহায়তা সময়মতো পৌঁছায়নি: প্রেস সচিব Dec 19, 2025
img
নওগাঁয় আ. লীগ নেতা সাইফুল গ্রেপ্তার Dec 19, 2025
img
ভেনেজুয়েলা ইস্যুতে ‘মারাত্মক ভুল’ না করতে যুক্তরাষ্ট্রকে করাবার্তা রাশিয়ার Dec 19, 2025
img
হাদির পথ ধরে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে : সালাম Dec 19, 2025
img
শাহবাগে ওসমান হাদির জন্য বিশেষ দোয়া Dec 19, 2025
img
সর্বসাধারণের জন্য ঢাবির কেন্দ্রীয় মসজিদে আনা হবে হাদিকে Dec 19, 2025
img

হ্যারি কেইন

ভক্তদের সন্তুষ্ট করতে বিশ্বকাপ জিততেই হবে ইংল্যান্ডের Dec 19, 2025
img
সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকার পথে হাদিকে বহনকারী বিমান Dec 19, 2025
img
বিকেলে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের আপডেট জানাবেন ডা. জাহিদ Dec 19, 2025
img
জানা গেছে হাদির ঘটনায় অভিযুক্ত ফয়সালের ভারতের অবস্থান Dec 19, 2025
img
গণমাধ্যমের ওপর হামলার ঘটনায় প্রেস সচিবের দুঃখপ্রকাশ Dec 19, 2025
img
জুমার নামাজের পর সকল রকমের কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান সারজিসের Dec 19, 2025
img
পর্তুগালে নাগরিকত্ব আইনের কিছু ধারা স্থগিত করল আদালত Dec 19, 2025
img
‘ব্যথা’ নিয়ে হাজির বাপ্পা মজুমদার Dec 19, 2025
img
সাম্প্রদায়িক শক্তি ফ্যাসিবাদের চেয়ে ভয়ংকর : গয়েশ্বর চন্দ্র রায় Dec 19, 2025
img
বাবার পাশে শায়িত হওয়ার ইচ্ছা জানিয়েছিলেন হাদি Dec 19, 2025
img
কারওয়ান বাজারে আগুন নেভাতে গিয়ে ২ ফায়ার ফাইটার আহত Dec 19, 2025
img
কারওয়ান বাজারে আগুন নেভাতে গিয়ে ২ ফায়ার ফাইটার আহত Dec 19, 2025