সুদানে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলার পেছনে কারা জড়িত?

সুদানের আবেইতে ড্রোন হামলায় ছয় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। তারা জাতিসংঘের অন্তর্বর্তী নিরাপত্তা বাহিনী আবেইর (ইউনিএসএফএ) অধীনে সেখানে মোতায়েন ছিলেন। গতকাল শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) এ ভয়াবহ হামলা হয়।

গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সুদানের সেনা-সরকার এ নিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছে। তারা নিন্দা জানিয়ে বলেছে, প্যারামিলিটারি র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) শান্তিরক্ষীদের ওপর ড্রোন হামলা চালিয়েছে।

দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান শান্তিরক্ষীদের ওপর এ হামলাকে ‘বিপজ্জজনক উত্তেজনা বৃদ্ধি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

আরএসএফ হলো সেই বাহিনী যারা দেশটির এল-ফেশার শহরে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়ে একদিনে দুই হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল।

তবে আরএসএফ হামলার দায় অস্বীকার করেছে। গতকাল শনিবার টেলিগ্রামে এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, শান্তিরক্ষীদের ওপর ড্রোন দিয়ে হামলা চালানোর যে দায় তাদের দেওয়া হচ্ছে এটি মিথ্যা।

ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরএসএফের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে করে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্রতম দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। যা কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ।

আরএসএফকে সরাসরি অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এল-ফেশারে ভয়াবহ গণহত্যা চালানোর পর তাদের নৃসংশতা জনসম্মুখে আসে।

>> সুদানে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত কীভাবে?

২০১৯ সালে সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তিনি ১৯৮৯ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিলেন।ওই বছর তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন সাধারণ মানুষ। এরপর সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তার তিন দশকের শাসনের অবসান ঘটায়। কিন্তু দেশটিতে গণতন্ত্র ফেরেনি। যেটির জন্য মানুষ এখনো সংগ্রাম করছেন।

২০১৯ সালে একটি সেনা-বেসামরিক যৌথ সরকার গঠন করা হয়। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে এ সরকারকেও ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।

>> অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে কারা?

ওই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। যিনি সুদানের সেনাপ্রধান একইসঙ্গে ডি ফ্যাক্টো প্রেসিডেন্ট।
আরেকজন হলেন আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো। তিনি ‘হামেদতি’ নামে বেশি পরিচিত।

কিন্তু এই অভ্যুত্থানের পর তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দেশ কিভাবে চলবে এবং বেসামরিক সরকার গঠন নিয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়।তাদের দুজনের মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্বের বিষয় ছিল আরএসএফের শক্তিশালী এক লাখ সদস্যকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে।আরএসএফ সেনাদের মূল সেনাবাহিনীতে যুক্ত করার পর তাদের নেতৃত্ব কে দেবে? এ নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

এই দুই জেনারেলের কেউই ক্ষমতা, সম্পদ, আধিপত্য কিছু ছাড়তে চাননি।

টানা কয়েকদিনের ব্যাপক উত্তেজনার মধ্যে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। এর জেরে দেশব্যাপী আরএসএফ সেনাদের মোতায়েন করা হয়। যেটিকে সেনাবাহিনী নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে নেয়।

কোন পক্ষ প্রথম গুলি ছুড়েছিল সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে খুব দ্রুত সশস্ত্র লড়াই সুদানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যে আরএসএফ রাজধানী খারতুমের বেশিরভাগ অংশ দখল করে ফেলে। টানা দুই বছর লড়াইয়ের পর সেনাবাহিনী ২০২৫ সালের মার্চে আবারও খারতুমের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়।

>> আরএসএফ কারা?

আরএসএফ গঠিত হয়েছিল ২০১৩ সালে। তারা মূলত কুখ্যাত জানজউইদ সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য ছিল। এ বাহিনী দারফুরের বিদ্রোহীদের কঠোর হস্তে দমন করেছিল। তাদের বিরুদ্ধে অ-আরবদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও নির্মমতার অভিযোগ রয়েছে।

দারফুরের বিদ্রোহীদের দমন ও নতুন বাহিনী প্রতিষ্ঠার পর থেকে আরএসএফ প্রধান জেনারেল দাগলো একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেন। যেটি ইয়েমেন এবং লিবিয়াতেও সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।

আরএসএফ প্রধান সুদানের কিছু সোনার খনির নিয়ন্ত্রণ করেন। এখানকার সোনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।সুদানের সেনাবাহিনীর অভিযোগ, আরএসএফকে সহায়তা করে আরব আমিরাত। এছাড়া আমিরাত সরাসরি সুদানে ড্রোন হামলাও চালিয়েছে।যদিও আমিরাত এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

এছাড়া পশ্চিম লিবিয়ার শক্তিশালী মানুষ জেনারেল খলিফা হাফতারও আরএসএফকে সহায়তা করে বলে অভিযোগ সুদানের সেনাবাহিনীর। তাদের দাবি, আরএসএফকে অস্ত্র; এমনকি সেনা দিয়েও সহায়তা করেন খলিফা হাফতার।

২০২৫ সালের জুনের শুরুতে আরএসএফ লিবিয়া এবং মিসর সীমান্তর্বর্তী সুদানের বিশাল সীমান্ত এলাকা দখল করে। যা তাদের জন্য বড় জয় ছিল।

এরপর তারা অক্টোবরের শেষ দিকে দখল করে এল-ফাশার। যার অর্থ দারফুরের বেশিরভাগ এবং এর পার্শ্ববর্তী কোরদোফান অঞ্চল আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

আরএসএফ এসব জায়গায় বিদ্রোহী সরকার গঠন করেছে। যার অর্থ সুদান আবারও দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। এরআগে ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান নামে আলাদা একটি দেশের জন্ম হয়। যেখানে সুদানের বেশিরভাগ তেলক্ষেত্র গুলো ছিল।

সূত্র: রেডিওতামাজুজ, বিবিসি

এমআর/টিকে 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিজয় দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য প্রস্তুত জাতীয় স্মৃতিসৌধ Dec 15, 2025
img
মুস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিংয়ের পরও হারল দুবাই Dec 15, 2025
img
দেশের ক্রান্তিকাল কাটাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরার আহ্বান সালামের Dec 15, 2025
img
সুপ্রিম কোর্টের এজলাস কক্ষে ‘অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির’ প্রবেশ নিষিদ্ধ Dec 15, 2025
img
জিজ্ঞাসাবাদে সদুত্তর দিতে পারেননি আনিস আলমগীর, রাতে থাকতে হচ্ছে ডিবিতে Dec 15, 2025
img
সৌদিতে এক সপ্তাহে প্রায় ২০ হাজার প্রবাসী গ্রেপ্তার, ফেরত পাঠানো হলো ১২,৩৬৫ জনকে Dec 15, 2025
img
বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য, চবি উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি ছাত্রদলের Dec 15, 2025
img
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে সকল অপশক্তি পরাস্ত হবে : ইশরাক Dec 15, 2025
img
বৈজ্ঞানিকভাবে মাছ চাষ খাদ্য নিরাপত্তায় নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে: উপদেষ্টা ফরিদা আখতার Dec 15, 2025
img
সিলেটে আওয়ামী লীগের ৬ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার Dec 15, 2025
img
খুলনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ গেল যুবকের Dec 15, 2025
img
আমরা ভালো করেই জানি কারা বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়েছিল: মির্জা ফখরুল Dec 15, 2025
img
তারেক রহমান লন্ডনে আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন ১৬ ডিসেম্বর Dec 15, 2025
img
নাশকতা মামলায় যমুনা অয়েলের সিবিএ নেতা কারাগারে Dec 15, 2025
img
কুমিল্লায় নাশকতার মামলায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২ নেতা গ্রেপ্তার Dec 15, 2025
img
পেশাজীবীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা চাইলেন তারেক রহমান Dec 15, 2025
img
ওমরাহ করানোর প্রলোভন দেখিয়ে ভোট চাচ্ছেন জামায়াত প্রার্থী, ভিডিও ভাইরাল Dec 15, 2025
img
অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র সৈকতে হামলায় প্রাণ গেল ১২ জনের, হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশ Dec 15, 2025
img
৮ হাজার ৫০১টি পদ সংরক্ষণের নির্দেশ হাইকোর্টের Dec 15, 2025
img
বিশ্বশান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার অটুট থাকবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা Dec 15, 2025