বলিউডের নতুন স্পাই থ্রিলার ‘ধুরন্ধর’ ভারত ও পাকিস্তানে একযোগে প্রশংসা ও তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ছবিটির কাহিনী, উপস্থাপন ও রাজনৈতিক বার্তা নিয়ে দুই দেশেই প্রশ্ন উঠেছে।
গত ৫ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া ৩ ঘণ্টা ৩২ মিনিটের এই সিনেমায় ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী এক গুপ্তচর জগতের গল্প দেখানো হয়েছে। এতে রয়েছে সহিংসতা, গ্যাংস্টার ও গোয়েন্দা সংস্থার দ্বন্দ্ব।
ছবিটি মুক্তির সময়টাও আলোচনায় এসেছে। কারণ, চলতি বছরের মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের পেহেলগামে এক পর্যটন কেন্দ্রে হামলার পর ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। তবে ইসলামাবাদ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান চারটি যুদ্ধে জড়িয়েছে। এরমধ্যে তিনটি যুদ্ধই হয়েছে 'কাশ্মির'কে ঘিরে।
সিনেমার গল্প কী?
আদিত্য ধর পরিচালিত ‘ধুরন্ধর’ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার 'র' এর এক গোপন অভিযানের গল্প তুলে ধরে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন রণবীর সিং। তিনি একজন ভারতীয় স্পাই। তাকে পাকিস্তানের করাচিতে ঢুকে গ্যাং নেটওয়ার্ক ভাঙার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সিনেমাতে রণবীর সিংয়ের বিপরীতে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা গেছে সঞ্জয় দত্তকে। তাকে পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানের 'প্রতীকী চরিত্র' হিসেবে দেখানো হয়েছে। এছাড়াও গ্যাংস্টারের ভূমিকায় আছেন অক্ষয় খান্না; সিনেমায় তার চরিত্রের নাম 'রহমান ডাকাত'। আর দিল্লিতে বসে কৌশল নির্ধারণ করা গোয়েন্দা কর্মকর্তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন আর মাধবন।
গল্পের গঠন ক্লাসিক ক্যাট-অ্যান্ড-মাউস ধাঁচের। একদিকে মাঠ পর্যায়ের অপারেশন। অন্যদিকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশল।
পাকিস্তানে কেন বিতর্ক?
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বৈরিতার পরও পাকিস্তানে বলিউড সিনেমার জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে পাকিস্তানকে চূড়ান্ত শত্রু হিসেবে দেখানো বলিউড স্পাই ছবিতে নতুন নয়।
এই ছবিতে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে করাচি শহর ও বিশেষ করে লিয়ারি এলাকার উপস্থাপন নিয়ে। লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেসের সমাজবিজ্ঞানী নিদা কিরমানি বলেন, সিনেমাতে দেখানো 'করাচি' শহর পুরোপুরি কল্পনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি ।
তার ভাষায়, করাচি কখনই এমন ছিল না। শহরের অবকাঠামো, সংস্কৃতি ও ভাষা সবকিছুই ভুলভাবে দেখানো হয়েছে। সহিংসতাকে শহরের একমাত্র পরিচয় বানানো হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে, পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) এক নেতা করাচির আদালতে মামলা করেছেন। অভিযোগ, সিনেমাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছবি অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি পিপিপির নেতাদের 'সন্ত্রাসীদের মদদদাতা' হিসেবে দেখানো হয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, লিয়ারির স্থানীয় গ্যাংগুলোকে ভারত-পাকিস্তান ভূরাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে দেখানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বাস্তবে এসব গ্যাং কেবল স্থানীয় পর্যায়েই সক্রিয় ছিল।
মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র সমালোচক ময়াঙ্ক শেখর বলেন, ছবিটির নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীরা করাচিতে কখনোই যাননি। তাই শহরটিকে ধ্বংসস্তূপের মতো দেখানো হয়েছে। তিনি একে হলিউডের সেপিয়া টোনে 'তৃতীয় বিশ্বের শহর' দেখানোর প্রবণতার সঙ্গে তুলনা করেন।
ভারতে প্রতিক্রিয়া কেমন?
ভারতে ‘ধুরন্ধর’ বাণিজ্যিকভাবে বড় সাফল্য পেয়েছে। প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যেও সিনেমাটি জনপ্রিয়।
তবে সমালোচনা এখানেও আছে। শহীদ ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর মোহিত শর্মার পরিবার দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করেছে। তাদের অভিযোগ, অনুমতি ছাড়া তার জীবন কাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে। নির্মাতারা অবশ্য বলছেন, সিনেমাটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
তবুও ছবিতে বাস্তব হামলার অডিও ক্লিপ ও সংবাদ ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বাস্তব ও কল্পনার সীমারেখা ঝাপসা হয়েছে বলে মত সমালোচকদের।
বলিউডে কি নতুন ধারা তৈরি হচ্ছে?
সমালোচকদের মতে, অতিরঞ্জিত পুরুষতান্ত্রিক নায়কভিত্তিক গল্প বলিউডে নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মূলধারার ছবিতে সংখ্যালঘুদের নেতিবাচকভাবে দেখানোর প্রবণতা বেড়েছে।
নিদা কিরমানির মতে, এতে মুসলমানদের প্রায়শই 'সন্ত্রাসী' হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এতে ভারতের ভেতর মুসলমানরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন।
এর আগে ‘আর্টিকেল ৩৭০’ ও ‘কেরালা স্টোরি’ নিয়েও একই ধরনের বিতর্ক হয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেসব ছবির প্রশংসা করলেও সমালোচকরা সেগুলোকে 'প্রচারমূলক' বলেছিলেন।
‘ধুরন্ধর’ নিয়ে সমালোচনা করায় কিছু সমালোচক অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ভারতের ফিল্ম ক্রিটিকস গিল্ড এই সংগঠিত আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে।
সব মিলিয়ে, ‘ধুরন্ধর’ শুধু একটি স্পাই থ্রিলার নয়। এটি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, ইতিহাস ও রাজনীতিকে ঘিরে নতুন করে বিতর্ক উসকে দিয়েছে।
এমকে/এসএন