বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা না মতাদর্শিক রাজনীতি - প্রথম আলো নিয়ে লিখলেন মির্জা গালিব

বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও রাজনীতির সম্পর্ক ঘিরে নতুন করে বিতর্ক সামনে এসেছে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার বদলে মতাদর্শিক অবস্থান, সহিংসতা উপস্থাপনায় দ্বৈত মানদণ্ড এবং ‘আমরা বনাম তারা’ রাজনীতির অভিযোগ তুলে একটি বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে-এই প্রবণতা শুধু গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং সমাজে বিভাজন আরও গভীর করছে। একই সঙ্গে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আইন ও মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষার মাধ্যমে একটি যৌথ গণতান্ত্রিক পরিসর গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর, ২০২৫) নিজের ভেরিফাইড ফেসবুকে তিনি এমন কথা বলেন।

বাংলাদেশ টাইমস'র পাঠকদের জন্য ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হল।

এক,
প্রথম আলো যতটা না বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করে, তার চাইতে অনেক বেশি করে মতাদর্শিক রাজনীতি। বাংলাদেশ একটা "ব্যর্থ রাষ্ট্র" হয়ে উঠছে, বা "ইসলামী মৌলবাদ" দেশটাকে প্রতিক্রিয়াশীল বানায়ে ফেলতেছে - এই জুজুর ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ইসলামোফোবিক সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠার যে রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে, প্রথম আলোর রাজনীতি তার চাইতে কম কিছু না। The Dissent এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে, জামায়াত বা হেফাজত সংশ্লিষ্ট সহিংসতার নিউজে প্রথম আলো খুব কম্ফোর্টেবলি ‘জামায়াতের সহিংসতা’, ‘জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব’, ‘বর্বরতা’, ‘হেফাজতের তাণ্ডব’, ‘হেফাজতের ধ্বংসযজ্ঞে নিঃস্ব’, ‘হেফাজতের সহিংসতা’, ‘যুদ্ধক্ষেত্র’-এই শব্দগুলো ব্যবহার করে। কিন্তু সারপ্রাইজিংলি আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সহিংসতার নিউজে তারা ভাববাচ্যে চলে যায়, যেমন-‘হামলা হয়েছে’, ‘ঘুমন্ত ব্যক্তির মৃত্যু’, ‘বাসে আগুন’; বড়জোর বলে যে ‘দুর্বৃত্তদের হামলা’। এই রাজনীতির মধ্য দিয়ে তারা মূলত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির এক ধরনের বৈধতার পাটাতন তৈরি করার চেষ্টা করে। এই কাজ কেন করে তারা? কারণ আওয়ামী লীগ ‘মুক্তিযুদ্ধের’ রাজনীতি করে, সেকুলার রাজনীতি করে। কাজেই আওয়ামী লীগই তাদের শেষ ভরসা। এই রাজনীতি মূলত একটা ফার রাইট রাজনীতি, স্রেফ "us versus them" রাজনীতি।

দুই,
বাংলাদেশে সেকুলাররা নিজেদের লিবারেল বলে দাবি করে কিন্তু রাজনীতি করে মূলত ফার রাইট। এদের এই রাজনীতির আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো সিলেক্টিভ মোরালিটি। প্রথম আলোর অফিস পুড়লে সেটা হয় বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপরে আঘাত; কিন্তু নয়া দিগন্তের অফিস পুড়লে, সংগ্রামের অফিসে ভাঙচুর হলে, কিংবা আমার দেশের সম্পাদকের উপর শারীরিক হামলা হলে দেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার খুব বেশি একটা রকমফের হয় না।

কারণ এদের কেউ কেউ ‘দলীয় পত্রিকা’, কেউ কেউ ‘চান্স সম্পাদক’! ‘শরীফ’, ‘এলিট’ সাংবাদিকতা করে কেবল প্রথম আলো, আর ‘শরীফ’, ‘এলিট’ রাজনীতি করে শুধু সেকুলাররা!

তিন,
কিন্তু এই রাজনীতির কারণে প্রথম আলোর অফিস ভাঙচুর করা, তাদের অফিসে কর্মরত সাংবাদিকদের জীবনকে প্রশ্নের মুখে ফেলা কি কোনো ভালো রাজনীতি? অবশ্যই না। যে সকল ক্ষুব্ধ তরুণরা "কালচারাল ফ্যাসিস্ট"দের প্রতি ক্ষোভ থেকে এই কাজে ন্যায্যতা খোঁজেন, তাদের কাজও দিনের শেষে "us versus them" রাজনীতিতেই পরিণত হয়। বাজে শত্রুর সাথে ফাইট করার এই একটা ঝামেলা, সে আপনাকে টেনে নিচেই নামিয়ে ফেলে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যে বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি-সেখানে সবার জন্য ন্যায্যতা থাকতে হবে, আইনের শাসন থাকতে হবে, মানবাধিকার থাকতে হবে। প্রথম আলোকে প্রচণ্ড সমালোচনা করার পরও তার সাংবাদিকতা করার পূর্ণ অধিকার দিতে হবে। তাদেরকে তাদের কথা বলার, তাদের রাজনীতি করার উন্মুক্ত জায়গা দিতে হবে।

চার,
বাংলাদেশে ‘সেকুলার’ আর ‘ধার্মিক’ জনগণের মধ্যে কালচারাল পার্থক্য আছে, দুই ক্যাম্পের রাজনীতির মধ্যে মতাদর্শিক পার্থক্য আছে। কিন্তু দেশটা আমাদের সবার। এই মতপার্থক্য সহই কীভাবে আমরা একসাথে কিছু কমন গ্রাউন্ডে আসতে পারি সেই চেষ্টা আমাদের করতে হবে। এই চেষ্টা করার প্রথম ধাপ হলো-আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বন্ধ করতে হবে আর পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করতে হবে। জেনারেশনের পর জেনারেশন নিজের দেশের লোকজন একজনের সাথে আরেকজনের শত্রুতা চলতেই থাকবে-এইটার কোনো মানে নাই। আমার দেশের অফিস ভাঙলে এক গ্রুপ চুপ থাকবে, প্রথম আলোর অফিস ভাঙলে আরেক গ্রুপ চুপ থাকবে - এই সিলেক্টিভ মোরালিটি থেকে আমাদের বের হবার এখনই সময়।

টিকে/

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নয়, ভোটার নিয়োগ হয় : সালাহউদ্দিন আম্মার Dec 23, 2025
img
কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের দিকে আসা বিক্ষোভকারীদের লাঠিচার্জ Dec 23, 2025
img
বিপিএলে সিলেটের শিরোপা জয়ে আত্মবিশ্বাসী এবাদত Dec 23, 2025
img
চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় যাচ্ছেন ১০ হাজার বিএনপি নেতাকর্মী Dec 23, 2025
img
মুদির দোকান থেকেও সাফল্য সম্ভব: প্রতীক সেন Dec 23, 2025
img
হাদির ঘটনায় ফয়সালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কবির ফের ৫ দিনের রিমান্ডে Dec 23, 2025
img
অসুস্থ এমপি প্রার্থী, সাতক্ষীরা থেকে হেলিকপ্টারে নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকায় Dec 23, 2025
img
ভারত থেকে ৫০ হাজার টন চাল আনা হবে: অর্থ উপদেষ্টা Dec 23, 2025
img
নোয়াখালীতে ২ গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ৫ Dec 23, 2025
img
ডিসেম্বরের ২২ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এলো ২৪২ কোটি ডলার Dec 23, 2025
তারেক রহমানকে দেখতে মঞ্চের পাশে রাত দিন কাটাচ্ছে যে পরিবার! Dec 23, 2025
img
দুই চ্যাম্পিয়নের লড়াইয়ে জয় পেল না কেউ Dec 23, 2025
img
এই জন্মে গানই শেষ ঠিকানা, অভিনয় ছাড়ার বিষয়ে জোজোর মন্তব্য Dec 23, 2025
img
ফলাফল নিয়ে চিন্তা না করে ভালো ক্রিকেট খেলাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন অঙ্কন Dec 23, 2025
img
শেরপুরে বিপুল মাদকসহ কারবারি গ্রেপ্তার Dec 23, 2025
img
ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনে হামলা, গভীর উদ্বেগ প্রকাশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের Dec 23, 2025
img
ময়মনসিংহে ২ বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত ১১ Dec 23, 2025
img
২০২৫ মাতিয়েছে ঢালিউড: যেসব সিনেমা দর্শক হৃদয় জয় করেছে Dec 23, 2025
img
১১৯ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করল জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট Dec 23, 2025
পরিবার, রাজনীতি ও দেশ নিয়ে জাইমার আবেগঘন বার্তা Dec 23, 2025