অবসরে জাপানিরা জেলে থাকতে চান কেন?

পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘায়ু দেশের মধ্যে অন্যতম একটি জাপান। যেখানে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি ৬৫ বছরের উপরে। জানা যায়, বয়স্ক জাপানিদের অনেকেই অবসরে যাওয়ার পর জেলে থাকতে চান। এজন্য তাদের অনেকেই ইচ্ছে করে বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট অপরাধ করে। যাতে তাদের জেলে থাকার সুযোগ হয়।

লক্ষ্য করা গেছে যে, গত বিশ বছর ধরে দিন দিন বয়স্ক জাপানিদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কেন? কেন বয়স্ক জাপানিরা অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠছে? আর কেনই বা তারা ইচ্ছে করে জেলে থাকতে চায়?

সম্প্রতি এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেন বিবিসির এক প্রতিবেদক। হিরোশিমার পুনর্বাসন কেন্দ্রে এ প্রতিবেদক এমনই একজন জাপানির দেখা পান, যিনি বারবার ইচ্ছে করে জেলে গিয়েছেন। ৬৯ বছর বয়সী এই জাপানির নাম তোশিও তাকাতা।

তোশিও জানান, তিনি বেশ কয়েকবার ইচ্ছে করে আইন ভঙ্গ করে জেলে গিয়েছেন। কিন্তু কেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, এর প্রধান কারণ তার দরিদ্রতা। সম্প্রতি তিনি অবসরে গিয়েছেন। এখন তিনি এমন একটি জায়গা খুঁজছেন, যেখানে বিনামূল্যে থাকা যায়। এমনকি এটা মদের বার হলেও।

তিনি বলেন, ‘আমি পেনশনে চলে গেছি, আমার টাকা ফুরিয়ে গেছে। আমি যদি জেলে যাই তাহলে বিনামূল্যে থাকতে পারব। তাই আমি একটি বাইসাইকেল চুরি করি এবং পুলিশ স্টেশনে গিয়ে বলি যে, আমি এটা চুরি করেছি।’

তোশিওর পরিকল্পনাটি কাজে লাগে। এটা ছিল তার প্রথম অপরাধ। তবে অপরাধটি ছোট হলেও জাপানে এসব ছোটখাটো অপরাধকেও অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়। তাই তার এক বছরের জেল হয়।

‘জেল থেকে বের হবার পর আমি একটি পার্কে যাই এবং কিছু লোককে ছুরি দেখিয়ে ভয় দেখাই। তাদের ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। আমি কেবল চেয়েছিলাম যে তাদের কেউ পুলিশকে ফোন করুক। আর সেটাই হয়েছে। তাদের একজন পুলিশকে ফোন দিল। আমি জেলে চলে গেলাম’- বলেন তোশিও।

তোশিও যখন এই অপরাধটি করেছিলেন তখন তার বয়স ৬২। যদিও তিনি কোনো পেশাদার অপরাধী না। তবুও এভাবে তিনি গত আট বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই জেলে কাটিয়েছেন। তোশিও জাপানে লক্ষণীয়ভাবে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির একজন প্রতিনিধি।

ব্যাপকভাবে আইন মান্যকারী একটি সমাজ ব্যবস্থা জাপান। যেখানে গত বিশ বছর ধরে ৬৫ বছরের উপরের জনসংখ্যার মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে চলেছে। ১৯৯৭ সালে যেখানে প্রতি বিশটি অপরাধের একটি সংঘটিত হত পঁয়ষট্টি ঊর্ধ্ব ব্যক্তিদের দ্বারা, সেখানে বিশ বছর পর বর্তমানে প্রতি পাঁচটি অপরাধের একটির সঙ্গে এই বয়স্করা জড়িত।

১৯৯০ সালেও যেখানে ষাটোর্ধ জাপানিরা প্রায় ৫শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল সেখানে ২০১৬ সালে এসে এর হার বেড়ে প্রায় ২০শতাংশ।

তোশিওর ন্যায় অনেক বয়স্ক জাপানিরা এভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। যেখানে ২০১৬ সালে আড়াই হাজার অপরাধ সংঘটিত হয় পঁয়ষট্টি ঊর্ধ্ব ব্যক্তিদের দ্বারা।

তোশিওর ন্যায় আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে- কেইকো (ছদ্ম নাম)। ৭০ বছর বয়সী এই নারীও বিবিসির ওই প্রতিবেদককে বলেছেন যে, তিনি দরিদ্রতার জন্যই এমনটা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি স্বামীর সঙ্গে থাকতে পারি না। আমার এখন বসবাসের কোনো জায়গা নেই। তাই আমার কাছে একটাই বিকল্প: চুরি করা।’

‘এমনকি আশি বছর বয়সেও যখন নারীরা হাটতে পারেন না, তখনও তাদেরকে এমন অপরাধ করতে হয়। এর একমাত্র কারণ তাদের খাদ্য ও অর্থের অভাব’- বলেন কেইকো।

একজন অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত টোকিও ভিত্তিক গবেষক মাইকেল নিউম্যান বলেন, জাপানের রাষ্ট্রীয় পেনশন অতি অল্প যে, তা দিয়ে জীবন চালানো খুবই কঠিন।

২০১৬ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, জাপানিরা যে পেনশন পায় তা বাসা ভাড়া, খাদ্য আর চিকিৎসা ব্যয়ে চলে যায়। আয়ের অন্য কোনো উৎস না থাকায় জামা-কাপড়সহ অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে তাদেরকে দেনা করতে হয়।

তাছাড়া, পূর্বে সন্তানরা বাবা-মার দেখাশোনা করতো। কিন্তু বিভিন্ন প্রদেশে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়ায় তারা বাবা-মাকে একা রেখে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। ফলে এসব বাবা-মাকে নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়।

তাই বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের উপর বোঝা হতে চায় না বলেই বয়স্করা জেলে থাকার মত কৌশল গ্রহণ করছে। শুধু তাই নয়, একই কারণে জাপানিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান মাইকেল নিউম্যান।

হিরোশিমার ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক কানিচি ইয়ামাদা বলেন, জাপানের বদলে যাওয়া পরিবার কাঠামোই বয়স্কদের অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তবে এসব অপরাধের জন্য অর্থনৈতিক কারণের চেয়ে মনোসামাজিক কারণকে তিনি গুরুত্ব দেন।

তার মতে, মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে। মানুষ এখন আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তারা সমাজে নিজেদের স্থান খুঁজে পায় না। এই একাকীত্বের সঙ্গে তারা খাপ খাওয়াতে পারে না বলেই এমন অপরাধ প্রবণ হয়ে যাচ্ছে বলে কানিচি ইয়ামাদা মনে করেন।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ট্রলারসহ ৬ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেল আরাকান আর্মি Nov 06, 2025
img
বিএনপি প্রার্থীকে গুলি, গভীর উদ্বেগ প্রকাশ জাতীয় যুবশক্তির Nov 06, 2025
img
সিলেট-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন আরিফুল হক চৌধুরী Nov 06, 2025
img
চট্টগ্রামে বিএনপির ২ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ ৫ Nov 06, 2025
img
বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে সাক্ষাতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত অন্তত ১০ Nov 06, 2025
img

২০২৬ বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপের ২২ দেশের জার্সি প্রকাশ করল অ্যাডিডাস, আলোচনায় আর্জেন্টিনা Nov 06, 2025
img
আগামী প্রজন্মকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় সমন্বিতভাবে গড়ে তুলতে চায় বিএনপি : আমিনুল হক Nov 06, 2025
img
শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার প্রেতাত্মারা রয়ে গেছে : আলতাফ হোসেন চৌধুরী Nov 06, 2025
img
সালমানের বিরুদ্ধে বিজেপি নেতার মামলা Nov 06, 2025
img
গণসংযোগে নিহত সরওয়ার বিএনপির কেউ নন : আমীর খসরু Nov 06, 2025
img
চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিলেন বিএনপির ২৮ নেতাকর্মী Nov 05, 2025
img
ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে হবে : বাবুল Nov 05, 2025
img
চট্টগ্রামে বিএনপি প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের Nov 05, 2025
img
কুসিকের বিএনপিপন্থি সাবেক কাউন্সিলররা সমর্থন জানালেন মনিরুল হককে Nov 05, 2025
img
রাতে ব্রুজের বিপক্ষে অনিশ্চিত লামিনে ইয়ামাল! Nov 05, 2025
img
মুঞ্জ্যা’র মূল চরিত্রে ভাবা হয়েছিল শ্রদ্ধা কাপুরকে! Nov 05, 2025
img
নেত্রকোনার নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক গ্রেপ্তার Nov 05, 2025
img
পদ্মার ন্যায্য পানি বণ্টনের দাবিতে বিএনপির সমাবেশ Nov 05, 2025
img
মামদানির সাফল্যে তার মায়ের বার্তা Nov 05, 2025
img
এনসিপি অচিরেই তাদের ভুল বুঝতে পারবে: মুনতাসির মাহমুদ Nov 05, 2025