একাত্তরের সেই সম্মিলিত পরাজিত শক্তিই ১৫ আগস্টের কুশীলব

১৫ আগস্ট। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত একটি দিন। ৭৫ এর এ দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর চক্রান্তে তাদের এ দেশীয় অনুচরেরা হত্যা করে বাঙালি জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে। নিষ্ঠুরতার এ হত্যাকাণ্ডের কাছে পৃথিবীর বড় বড় ট্র্যাজেডিও ম্লান হয়ে যায়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন- ‘দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।’ (পৃষ্ঠা ১৬৪) এ দেশের মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন। জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবী জানাতেন। বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য হিস্যা চাইতেন। এই ছিল তাঁর অপরাধ। সে দাবী তিনি আদায়ও করে নিয়েছেন। বিনিময়ে তাঁর প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে নির্মমভাবে।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সে সময় এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’
বঙ্গবন্ধু কেবল বাঙালি নয়, তিনি বিশ্বের বুকে অধিকার বঞ্চিত মানুষের প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাই বিশ্বে যেসকল শাসক জনগণকে শোষণ করতো, অধিকার থেকে বঞ্চিত করতো শুধু তাদেরই অপছন্দের মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেখা গেছে ঐ সময় পাকিস্তানি জেনারেলদের যারা পোষত সেইসব দেশের শাসকরাই শুধু একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে। অপরদিকে বিশ্বের মুক্তিকামি জনগণ বাংলার মানুষের নৈতিক দাবীর পক্ষে ছিল। 

একাত্তরের সেই সম্মিলিত পরাজিত শক্তিই ১৫ আগস্টের নিশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা বিভিন্ন উপায়ে প্রমাণিত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও খুনীচক্র নিরাপদ বোধ করেনি। এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের অপরাধে দেশের প্রচলিত আইনে ভবিষ্যতে তাদের যাতে বিচার অনুষ্ঠিত না হয় সে উদ্দেশ্যে জারি করা হয় এক বর্বর অধ্যাদেশ, যা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামে পরিচিত। এভাবে আইন করে হত্যাকাণ্ডের বিচার নিষিদ্ধ করা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন এবং গণতন্ত্র, ন্যায়নীতি, মানবাধিকার ও সংবিধান বা আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। 

তারপর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে চার দশক পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচার করেছে।   

আজকে এটা প্রমাণিত যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল আসলে বাংলাদেশকে পঙ্গু, ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যই। বাংলাদেশ যেন বিশ্বে স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেই লক্ষ্য অর্জনই ছিল ঘাতকদের উদ্দেশ্য। ৭৫ এর পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে আমরা এর সমর্থন পাই। বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে আমরা একটি সুখী সুন্দর সোনার বাংলা অনেক আগেই অর্জন করতে পারতাম। বিজয় অর্জনের পর সরকার গঠন করে তিনি একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে যেভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটাই তার প্রমাণ বহন করে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ’ নামক তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতো ৯ শতাংশ। এ হিসেব নিরূপণে বিভিন্ন যৌক্তিক অনুসিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ধরে নিয়েছি যে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ২০১১ সাল নাগাদ (তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স হতো ৯০ বছর) তিনি মোট ৭ টি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পূর্ণ সময়সহ অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম ৩ বছর সময় পেতেন।’ 

মূলত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যবচ্ছেদ রেখা। এই রেখা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তিকে আলাদা করে রেখেছে। এ জন্যই বেগম খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট তার ভুয়া জন্মদিনের উৎসব করেন। এ উৎসব আসলে জন্মদিনের উৎসব নয়, খুনিদের প্রতি সমর্থনের ঘোষণা। অন্যদিকে জাতির শোকের দিনে জন্মদিন পালন করতে গিয়ে বেগম জিয়া কেবল বিতর্কিত নয়, ঘৃণিত সবার চোখে।  

কতভাবেই ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করেছে বিএনপি, জামায়াত তথা স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। কিন্তু জনগণের সত্যিকারের ভালোবাসা সেতো হৃদয়ে লেখা, সেখান থেকে তো আর মুচা যায়না, যায়নি, যাবেও না কখনো। দেশের জনগনই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ নির্মাণ করে চলেছেন। ‘তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান’ প্রবন্ধে আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘একজন ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক মিশনকে হত্যা করা যায় না। কারণ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে; কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই।’



লেখক- ফরিদুন্নাহার লাইলী, কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য। 


Share this news on:

সর্বশেষ

img
উত্তপ্ত প্রেস ক্লাব,এনটিআরসিএর নিয়োগ প্রত্যাশীদের লংমার্চে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ Jun 15, 2025
img
ঈদে বুবলীকে কি দিলেন শাকিব? Jun 15, 2025
img
৭ কোটি বছরের ডাইনোসরের দেহে ক্যান্সার! চিকিৎসাবিজ্ঞানে যুগান্তকারী আবিষ্কার Jun 15, 2025
img
খামেনির সাধারণ ক্ষমায় ১৭০৫ বন্দির মুক্তি Jun 15, 2025
img
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত থামাতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব ট্রাম্পের Jun 15, 2025
img
নতুন রূপে ‘তারে জমিন পার’ কেন বানালেন আমির? Jun 15, 2025
img
সৌন্দর্যের পেছনের রহস্যের কথা স্বীকার করলেন মেগান ফ্ক্স Jun 15, 2025
img
আরো ৩৬টি দেশের নাগরিকদের উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে ট্রাম্প Jun 15, 2025
img
এবার অভিনেত্রী পুজা ব্যানর্জির উপরেই অপহরণের অভিযোগ Jun 15, 2025
img
ঊর্ধ্বতন ৪ পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বে রদবদল Jun 15, 2025
img
নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ এগিয়ে এসেছে, আমরা শুধু রেফারি : সিইসি Jun 15, 2025
"আন্দোলন থেকে উপদেষ্টার দরজায় – পুলিশের ব্যতিক্রমী ভূমিকা" Jun 15, 2025
লন্ডন বৈঠকের পরই নির্বাচনি মাঠে তুঙ্গে বিএনপির তৎপরতা Jun 15, 2025
ইরান - ইসরায়েল উত্তেজনার মধ্যেই সৌদি যুবরাজকে ফোন! Jun 15, 2025
img
যেকোনো পোশাক এক বা দুইবারের বেশি পরি না: বর্ষা Jun 15, 2025
img
স্বাস্থ্যবিধি মানতে পরীক্ষাকক্ষের আসন বিন্যাসে বাড়ানো হবে দূরত্ব Jun 15, 2025
img
রোজার স্নিগ্ধ হাসিতে মুগ্ধ নেটিজেনরা Jun 15, 2025
img
রাজনৈতিক কারণেই আমাকে শপথ পড়ানো হচ্ছে না: ইশরাক Jun 15, 2025
img
ইরানের পাশে দাঁড়ালো কাতার Jun 15, 2025
img
আ.লীগ নেতাকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াত নেতার মাংস বিতরণের ছবি,নতুন বিতর্কের সৃষ্টি Jun 15, 2025