কিটো ডায়েট সবার জন্য উপযুক্ত নয়

কিটোজেনিক বা কিটো ডায়েট হলো বিশেষ ধরনের খাদ্য পরিকল্পনা, যেখানে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে চর্বির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়।

সাধারণ খাদ্যাভ্যাসে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ সাধারণত ৫০-৬০ শতাংশ থাকে, তবে কিটো ডায়েটে এটি মাত্র ৫-১০ শতাংশে সীমিত রাখা হয়।

এদিকে, সাধারণ খাদ্যাভ্যাসে চর্বির পরিমাণ থাকে ২০-২৫ শতাংশ, কিন্তু কিটো ডায়েটে এটি বেড়ে ৭৫ শতাংশে পৌঁছায়।

আমিষ বা প্রোটিনের পরিমাণ সাধারণ ডায়েটের মতোই ২০-২৫ শতাংশ রাখা হয়, যা শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি বজায় রাখতে সহায়তা করে।

কিটো ডায়েট বলতে আসলে স্বল্প কার্বোহাইড্রেইট ও উচ্চ চর্বি সমৃদ্ধ খাবারকে বোঝায়, এটাকে অনেকে ‘মিলিটারি ডায়েট’ও বলে থাকে।

ঢাকা শিশু হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল ও ‘বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন’য়ের সাবেক পুষ্টিবিদ আজিজুন নাহার কিটো ডায়েট সম্পর্কে তিনি বলেন, “মৃগী রোগ বা এপিলেপসি রোগীদের শরীরে কিটোনবডিগুলো জাড়িত হয় না বলে প্রাচীনকাল থেকেই তাদের ওষুধের পাশাপাশি কিটোজেনিক ডায়েট করতে দেওয়া হয়। যেন কিটোনবডি সঠিক উপায়ে জাড়িত হতে পারে। এই রোগের জন্য কিটো ডায়েটের সূচনা হলেও বর্তমান সময়ে দ্রুত ওজন কমানো ক্ষেত্রে এই ডায়েট জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।”

কিটোনবডি হল, চর্বি বিপাক প্রক্রিয়ার সময় উৎপন্ন হওয়া তিনটি যৌগের সমষ্টি। এর মধ্যে দুটি যৌগ, যখন না খেয়ে থাকা হয় তখন শরীর শর্করার পরিবর্তে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত করে। আরেকটি হল আসিটন যা বিপাক প্রক্রিয়ায় ভেঙে যায়।
এই ডায়েট অনুসরণ করা বেশ কঠিন। ভাত আমাদের প্রধান খাবার হওয়াতে তা একদম কমিয়ে ফেলা ও কিটো ডায়েটের আনুসঙ্গিক অন্যান্য নিয়মাবলি মেনে চলা বেশ কষ্টকর।

এতে শর্করার পরিমাণ কম থাকায় অনেক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী এই ডায়েট অনুসরণ করে চলেন যা সাময়িকভাবে কাজ করলেও দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে ক্ষতির কারণ হতে পারে।

পুষ্টিবিদ আজিজুন নাহার কিটোজেনিক ডায়েটের কয়েকটি ধরন সম্পর্কে জানান।

স্ট্যান্ডার্ড কিটোজেনিক ডায়েট: খাদ্যে কার্বোহাইড্রেট ৫ শতাংশ, প্রোটিন ২৫ শতাংশ ও চর্বি ৭০ শতাংশ

সাইক্লিক্যাল কিটোজেনিক ডায়েট: এতে সপ্তাহে যে কোনো দুদিন চাইলে বেশি শর্করা ধরনের খাবার খেতে পারবেন।

টার্গেটেড কিটোজেনিক ডায়েট: এই ডায়েটে শরীরচর্চার আগে বা পরে শর্করা ধরনের খাবার খেতে পারবেন।

হাই-প্রোটিন কিটোজেনিক ডায়েট: এ পদ্ধতি অনেকটা স্ট্যান্ডার্ড কিটোজেনিক ডায়েটের মতো। তবে এতে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই ডায়েটে খাদ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ চর্বি, ৩৫ শতাংশ প্রোটিন ও ৫ শতাংশ শর্করা থাকে। সাধারণ মানুষদেরকে যারা ওজন কমাতে চান তাদের ‘স্ট্যান্ডার্ড কিটোজেনিক ডায়েট’ দেওয়া হয়।

বিশেষ ব্যক্তিদের যাদের স্বাস্থ্যে দ্রুত পরিবর্তন আনতে হয় যেমন- বডিবিল্ডার, খেলোয়ার, তারকাদের ‘হাইপ্রোটিন কিটোজেন ডায়েট’য়ে পরামর্শ দেওয়া হয় বলে জানান এই পুষ্টিবিদ।

কিটো ডায়েটের খাবার তালিকাগুলো হল

কিটোডায়েট চলাকালীন যা খাওয়া যাবে- সপ্তাহে দুদিন মুরগির মাংস, চর্বিহীন গরুর মাংস, মাছ, সামদ্রিক মাছ, ডিম, মাখন ঘি, পনির। স্বাস্থ্যকর তেল যেমন- জলপাইয়ের তেল, নারিকেল তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি। তবে কোনোভাবেই সয়াবিন তেল খাওয়া ঠিক হবে না।

কিটো ডায়েট চলাকালীন যা খাওয়া যাবে না- চিনি, মিষ্টি, মিষ্টি-জাতীয় খাবার, ফলের জুস, ডাল ও ডাল-জাতীয় খাবার, মাটির নিচে হয় এমন খাবার- আলু, মিষ্টি আলু, আটা ও আটার তৈরি খাবার, ভাত, পাস্তা, ওটস, নুডুলস, কর্নফ্লেক্স ইত্যাদি।

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

এই ডায়েটের বেশ কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে বলে জানান এই পুষ্টিবিদ।

এতে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকায় অনেকের ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনিতে পাথর, হৃদরোগ, পিত্তথলিতে পাথর, থায়রয়েডের সমস্যা, চুল পড়ার সমস্যা, হজম ক্ষমতা কমা, ত্বকের নানাবিধ সমস্যা, উজ্জ্বলতা হ্রাস, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দেয়।

একজন পুষ্টিবিদ হিসেবে আজিজুন নাহার মনে করেন, “এটা মূলত উচ্চবিত্তদের জন্য প্রযোজ্য এবং যারা খেলোয়ার, জিম্নাস্টিক, বডিবিল্ডার বা তারকা যাদের বিশেষ প্রয়োজনে শরীর ও ওজনে পরিবর্তন আনতে হয় তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই ডায়েট করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা আছেন তাদের ওজন কমানোর জন্য কিটো ডায়েট করার কোনো প্রয়োজন নেই।”

কিটোজেনিক ডায়েট শরীরের কেবল ওজনই কমায় না বরং সামান্য ভুলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে।

তাই সাধারণ খাদ্যাভ্যাসে সামান্য পরিবর্তন, নিয়মিত শরীরচর্চা করা, হাঁটা চলা, ঘরের কাজ নিজে করা, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দৌঁড়ানো, উঠবস করা, খাবার থেকে মিষ্টি ও চিনি বাদ দেওয়া, কার্বোহাইড্রেইট গ্রহণের পরিমাণ খানিকটা কমানো ইত্যাদি করে সচেতন যে কোনো ব্যক্তিই ছয়মাস বা এক বছরের মধ্যে ওজনে পরিবর্তন আনতে পারেন।

তার মতে, “খাবারের সব উপাদানই শরীরে প্রয়োজন। তবে তা অবশ্যই পরিমিত। দীর্ঘ সময় ধরে এসব খাবারের ঘাটতি শরীরে ক্ষতি সাধন করে।”

তবে কেউ যদি বাড়তি ওজন কমাতে চান তাহলে তাকে অবশ্যই কোনো অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদের সহায়তা ও পরামর্শ অনুযায়ী এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পুষ্টিবিদের তত্ত্বাবধানে থেকে কিটো ডায়েট করতে পারেন।

কিশোর-কিশোরিদের মধ্যে ওজন কমানোর একটা ভয়ানক প্রবণতা দেখা দেয় এবং তারা না খেয়ে বা কিটো ডায়েট করে ওজন কমাতে চান।

তাদেরকে উদ্দেশ্য এই পুষ্টিবিদ বলেন, “হুজুগে বা নিজে নিজে পরিকল্পনা করে কিটো ডায়েট করা ক্ষতিকারক। এর চেয়ে বরং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, হালকা ব্যায়াম, হাঁটা চলার অভ্যাস গড়ে তোলা, পানি পান, সঠিক ঘুমচক্র মেনে চলে ওজন কমানোর পাশাপাশি শরীর সার্বিকভাবে সুস্থ রাখা সম্ভব।”

তাছাড়া তরুণ বয়সে শরীরে চর্বি খুব একটা জমাট বেঁধে থাকে না। তাই একটু চেষ্টা করলেই বাড়তি চর্বি কমানো যায়। এরজন্য কিটো ডায়েট করার প্রয়োজন নেই বলে জানান তিনি।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
নেতানিয়াহুর দেশের সাথে সম্পর্ক গড়বে সৌদি, আশা ট্রাম্পের Oct 18, 2025
img
ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলই চিনতাম না: জয়া আহসান Oct 18, 2025
img
জাকেরকে নিয়ে করা মন্তব্যে বাংলাদেশ কোচের বিরক্তি প্রকাশ Oct 18, 2025
img
চুল কাটতে গিয়ে কক্সবাজারের যুবলীগ নেতা ঢাকায় গ্রেপ্তার Oct 18, 2025
img
আমার ছেলে মেসির ফ্যান, তাই ফুটবল খেলা বেশি দেখি: শামা ওবায়েদ Oct 18, 2025
img
পাকিস্তানের হামলায় প্রাণ হারাল ৩ ক্রিকেটার, ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলবে না আফগানরা Oct 18, 2025
img
ফোনালাপে নেতানিয়াহুর ভূয়সী প্রশংসা করলেন মাচাদো Oct 18, 2025
img
রিয়াদে এক সিনেমায় শাহরুখ,সালমান ও আমির খান Oct 18, 2025
img
শাপলা প্রতীক নিয়ে মন্তব্য এনসিপি নেত্রী সামান্তার Oct 18, 2025
img
বিশ্ববাজারে সোনার দামে ফের রেকর্ড Oct 18, 2025
img
গুজরাটের মন্ত্রিসভায় জায়গা পেলেন রবীন্দ্র জাদেজার স্ত্রী Oct 18, 2025
img
ওয়েস্ট ইন্ডিজে ‘রশিদ-হাসারাঙ্গা’ না থাকায় স্বস্তিতে বাংলাদেশ Oct 18, 2025
img
অঙ্কনের সামর্থ্যে আস্থা রাখছেন প্রধান কোচ ফিল সিমন্স! Oct 18, 2025
img
জামায়াত ক্ষমতায় গেলে অমুসলিমরা সবচেয়ে ভালো থাকবে: রফিকুল ইসলাম খান Oct 18, 2025
img
সেনা হেফাজতে থাকা তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার নিয়ে ভিন্ন তথ্য! Oct 18, 2025
img
হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলেন খালেদা জিয়া Oct 18, 2025
img
ঐতিহাসিক যুদ্ধবিরতি’তে তুরস্কের অবদান রয়ে: জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী Oct 18, 2025
img
চীনে দুর্নীতির অভিযোগে সেনাবাহিনীর ৯ শীর্ষ জেনারেলকে বরখাস্ত Oct 18, 2025
img
প্রতিহিংসার রাজনীতি নয়, প্রতিযোগিতার রাজনীতি করুন: জুয়েল Oct 17, 2025
img
শেষ মুহূর্তে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কারো না আসাটা ডিস্টার্বের অংশ: মির্জা আব্বাস Oct 17, 2025