ঈদ সালামির প্রচলন কবে থেকে

মুসলিমদের অন্যতম প্রধান উৎসব হচ্ছে ঈদ। সারা বিশ্ব জুড়ে এই উৎসব পালিত হয়। পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে এদিন সকলে মিলেমিশে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ভ্রাতৃত্বের বন্দর ও আনন্দের বার্তা নিয়ে প্রতিবছর এই উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে।

ছোট বড় সবাই এই ঈদের আনন্দে সারা দিন মাতোয়ারা থাকেন।

তবে এই ঈদের আনন্দ বড়দের থেকেও ছোটরা বেশি উদযাপন করে। নতুন জামা থেকে শুরু করে ভিন্ন ধরনের খাবারদাবার খাওয়া, আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়াসহ নানা উৎসবে মেতে থাকে তারা। তাদের আনন্দের আরেকটি অন্যতম উৎসব হচ্ছে ঈদ সালামি।

ঈদ উপলক্ষ্যে জ্যেষ্ঠ সদস্যদের সালাম করে যেকোনো পরিমাণ অর্থ, অথবা অন্য কোনো উপহার আদায় করে তারা। এই ঈদ সালামি আবার ‘ঈদি’ বা ‘ঈদিয়া’ নামেও বহুল প্রচলিত। ঈদ ও হাদিয়া- এই দুই শব্দের সমন্বয়ে ঈদিয়া শব্দটি গঠিত।

প্রতিবছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার উৎসব উদযাপনের অংশ হিসেবে পরিবাবের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা ছোটদের এই উপহার প্রদান করে থাকেন।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, ইসলামে উপহার আদান-প্রদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে, সেটি কোনো শর্তযুক্ত হতে পারবে না।

বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, তোমরা একে অন্যকে উপহার দাও। এতে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। (আল-আদাবুল মুফরাদ; হাদিস নং: ৫৯৪)

কয়েকজন হাদিস বিশারদ এই হাদিসকে মানের দিক থেকে ‘হাসান’ বলেছেন।

ঈদ সালামির ইতিহাস-
‘ঈদ সালামি’ প্রচলনের ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, মধ্যযুগের শুরুর দিকে ‘ঈদ সালামি’ প্রদানের সূচনা হয়। ফাতিমীয় খিলাফতের সময়ে সমাজের শিশু-কিশোর ও বয়স্ক অধিবাসীদের অর্থ, মিষ্টান্নজাতীয় খাবার অথবা পোশাক উপহার দেওয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলুক সাম্রাজ্যের আমলে পোশাক-পরিচ্ছদ ক্রয় করার জন্য ঈদের সময় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থ প্রদান করার প্রচলন ঘটে। এই আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ ব্যক্তিভেদে আলাদা হতো এবং তা একজন ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুযায়ী নির্ধারণ করা হতো।

এরই ধারাবাহিকতায় উসমানী সাম্রাজ্যের শেষ দিকে এসে এই প্রথা ব্যাপকভাবে পারিবারিক পরিসরে বিকশিত হয়। এই সময় থেকে পরিবারের মাতা-পিতা ও জ্যেষ্ঠ সদস্যদের কাছ থেকে শিশুদের নগদ অর্থ উপহার পাওয়ার প্রচলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

ইসলাম ধর্ম প্রসারের কারণে ক্রমান্বয়ে ‘ঈদ সালামি’ প্রদানের এই রীতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি একসময় ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এটি একটি সামাজিক রীতি ও ঐতিহ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সালামি যেকোনো পরিমাণ নগদ অর্থ, অথবা অন্য কোনো উপহার হতে পারে।

সাধারণত কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান, আকিকা ও সুন্নতে খতনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা খুশি হয়ে নগদ অর্থ বা অন্য কোনো বস্তু উপহার দিয়ে থাকেন। একেও সালামি বলা চলে। অন্যান্য উৎসবের মতো ঈদকে কেন্দ্র করে শিশুদের মধ্যে উৎসাহ ও আনন্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। আর শিশুদের কাছে ঈদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি হলো পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের কাছ থেকে সালামি প্রাপ্তি।

অন্যদিকে, পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের কাছে ঈদ সালামি প্রদান হচ্ছে শৈশবের সোনালি স্মৃতি রোমন্থন করা এবং এই আনন্দ আয়োজন নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করে দেওয়ার উপলক্ষ্য।

ঈদের সালামির বর্তমান-
ঈদের দিন শিশুরা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে যথাসম্ভব নতুন পোশাক বা পাঞ্জাবি পরে ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে। ঈদের নামাজ আদায়ের পর কোলাকুলি করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর পরই শিশুরা পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের সালাম করে সালামি প্রদানের জন্য আবদার জানিয়ে থাকে। এরপর শিশুরা সালামি গ্রহণ করে উৎসবে মতে ওঠে এবং নগদ অর্থ ব্যয় করে নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে পারে। আবার এই শিশুরা একদিন বড় হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সালামি দেবে। এভাবে এই আনন্দ আয়োজনের ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্ব-মহিমায় টিকে থাকে।

অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে সালামির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো- সেই অর্থের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, সেটা চকচকে নতুন নোট হতে হবে। আর গ্রাহকদের এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে প্রতিবছর ঈদ উৎসবের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন নোট সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য উপহার ক্রয়-বিক্রয়ের কারণে দেশের অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল হয়ে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সালামি প্রদানের রীতিতে নতুনত্ব যুক্ত হয়েছে।

বর্তমানে যান্ত্রিকতার এই যুগে প্রযুক্তির কল্যাণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যাপক প্রসারের কারণে অনেকে দূরদূরান্তের প্রিয়জনকে সহজে সালামি দিতে পারেন। আর সেই সুযোগে তরুণ-তরুণিরা তাদের জ্যেষ্ঠদের কাছে সালামি চেয়ে থাকেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।

ঈদ সালামি প্রদানের ক্ষেত্রে নগদ অর্থের পরিমাণ কোনো বিষয় নয়, বরং সবাই মিলে উৎসবে শামিল হওয়ার আনন্দই মুখ্য। বর্তমানে ঈদ সালামি আদান-প্রদানের এই রীতি শুধু শিশুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তবে এই সময়ে এসে সালামি প্রদান খানিকটা আনুষ্ঠানিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি, এটি বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার একটি অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে এই আনন্দ আয়োজনের ব্যাপকতা ধীরে ধীরে আরো বেশি প্রসারিত হচ্ছে। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করার পাশাপাশি বিশেষ করে শিশুদের মাঝে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে দিতে ঈদের সালামি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সূত্র : রোয়ার বাংলা

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
নাশকতার মামলায় অব্যাহতি পেলেন মির্জা আব্বাস দম্পতি Oct 13, 2025
img
ঢাকা কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ধস্তাধস্তি Oct 13, 2025
img
হাসিনাসহ ৩ আসামির বিরুদ্ধে চলছে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন Oct 13, 2025
img
রঙিন ফুল, হাসি আর শাড়িতে অনিন্দ্য জয়া আহসান Oct 13, 2025
img
মালদ্বীপে অবৈধ ব্যবসা,আটক ৬ প্রবাসী Oct 13, 2025
img
২য় দিনের মতো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান করছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা Oct 13, 2025
img
আজ বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ নারী দল নামছে এশিয়ান কাপের টিকিটের লড়াইয়ে Oct 13, 2025
img
দেশের পরিস্থিতিটা খুব একটা শান্তিপূর্ণ নয় : জিল্লুর রহমান Oct 13, 2025
img
রাজধানীতে শ্রমিক লীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ৫ Oct 13, 2025
img
চট্টগ্রাম ছাড়া কোথাও বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই : আবহাওয়া অধিদপ্তর Oct 13, 2025
img
ফ্রান্সের জাতীয় দলের কোচ হতে চান জিদান Oct 13, 2025
img
গাজা শান্তি সম্মেলনে যোগ দেবে না ইরান Oct 13, 2025
img
জাতীয় দলে সুযোগ না পেলেও চিন্তিত নন চ্যাম্পিয়ন আকবর আলী Oct 13, 2025
img
ট্রাম্পকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা দেবে ইসরাইল: আল জাজিরা Oct 13, 2025
img
কুদুসের জাদুতে বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত করল ঘানা Oct 13, 2025
img
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায় ৩ কোটি রুপির সোনা উদ্ধার Oct 13, 2025
img
দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত ঢাকার সাবেক মহানগর হাকিম রেজাউল করিম Oct 13, 2025
img
জাতিসংঘের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি স্থগিত করল ইরান Oct 13, 2025
img
ব্র্যাম্পটন ব্লিটজকে ৪৩ রানে হারিয়েছে সাকিবের দল Oct 13, 2025
img
শেখ হাসিনাসহ ৩ আসামির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন আজ Oct 13, 2025