ঘুরে দাঁড়াচ্ছে চিংড়ি রপ্তানি

গত অর্থবছরে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন রপ্তানির পর আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন করে চাহিদা তৈরি হওয়ায় চলতি অর্থবছরে ফের ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি খাত।

তবে শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিংড়ির পোনার মতো কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান সংকটে টেকসই প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই–ফেব্রুয়ারি) চিংড়িসহ হিমায়িত ও জ্যান্ত মাছের রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ১৪.৪৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৬.২ মিলিয়ন ডলার।

এর মধ্যে শুধু চিংড়ির রপ্তানিই ১৭.০৬ শতাংশ বেড়ে ২১৫.৯ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩.২৫ শতাংশ।

সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ছয় মাস হিমায়িত ও জীবন্ত মাছের রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা বজায় রয়েছে। অথচ খুলনা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বহু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা এখনও বন্ধ। মূলত কাঁচামাল সংকট, আর্থিক চ্যালেঞ্জ ও চড়া ব্যয়ের কারণে বন্ধ আছে এসব কারখানা।

শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলেন, গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের সময় এই খাতে বড় ধাক্কা লাগে। তবে ইপিবির তথ্য বলছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর থেকেই চিংড়ি রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।

সদ্য বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফএ) সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন আছিয়া সি-ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তারিকুল ইসলাম জহির।
তারিকুল বলেন, 'রপ্তানি বাজারগুলো থেকে প্রচুর অর্ডার আসছে—তাই চিংড়ির চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। কিন্তু কাঁচামালের তীব্র সংকট আগামীতে টেকসই প্রবৃদ্ধিকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।

'চিংড়ি উৎপাদনকারীরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে টিকে থাকতে লড়াই করছেন। সে কারণে অধিকাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাই বন্ধ হয়ে আছে।'
অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, সংগঠনটির মোট ২০০ সদস্য প্রতিষ্ঠান চিংড়ি ও মাছ রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে বর্তমানে মাত্র ২৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান চালু আছে। বাকি ৭৫ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।

তারিকুল জানান, খুলনায় এখনও প্রায় ৩০টি কারখানা চালু থাকলেও স্থিতিশীল অবস্থায় আছে মাত্র ১০-১২টি। চট্টগ্রামের কারখানাগুলোর অবস্থাও খুব একটা ভালো না।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ ও হিমায়িত মাছের রপ্তানি বাড়লেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত দুটি চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের—এপেক্স ফুডস ও জেমিনি সি-ফুডস—পারফরম্যান্স মিশ্র।

তালিকাভুক্ত সবচেয়ে বড় মাছ রপ্তানিকারকদের একটি এপেক্স ফুডশের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটির আয় ২ শতাংশ কমেছে, মুনাফা কমেছে ২০ শতাংশ।
অন্যদিকে আয় হ্রাস ও আগের সময়ের তুলনায় মুনাফার মার্জিন কমে যাওয়ায় বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে জেমিনি সি-ফুডস।

শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়লেও কাঁচামালের সংকটে অনেক রপ্তানিকারক উৎপাদন বাড়াতে পারছে না। স্থানীয় অনেক মৎস্য খামারি চড়া উৎপাদন ব্যয়, অবকাঠামোর অভাব এবং আর্থিক সংকটের কারণে সাময়িকভাবে কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন।

কারখানা বন্ধ করে দেওয়া খুলনার একজন রপ্তানিকারক বলেন, 'আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের অর্ডার আছে, কিন্তু মাছের পোনা না থাকায় তা পূরণ করতে পারছি না। স্থানীয়ভাবে বৃহৎ পরিসরে চাষ না হলে রপ্তানি চাহিদা মেটানো কঠিন হবে।'

নীতিগত সহায়তা ও ভেনামি চিংড়ির দিকে ঝুঁকছে শিল্পখাত, তবে কাঁচামালের সংকটই বড় বাধা

ফের চাষ শুরু করতে মৎস্যচাষিদের সহায়তার লক্ষ্যে আর্থিক প্রণোদনা এবং অবকাঠামো উন্নয়নসহ নীতিগত সহায়তা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রপ্তানিকারক ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা গেলে বর্তমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক রপ্তানি আয়ও বাড়বে।
বিএফএফইএর একজন কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে চাহিদা অনেক বেশি। সঠিক সহায়তা পেলে বাংলাদেশের রপ্তানি অনেকটাই বাড়ানো সম্ভব। তবে কাঁচামালের সংকট এখনও বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রয়ে গেছে।

কাঁচামালের সংকটের কারণে শিল্প কেমন হুমকিতে রয়েছে, তা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রুপালী সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিএফএফইএর সহসভাপতি শেখ কামরুল আলম প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য আগের সরকারের নীতিকে দায়ী করেন। তবে চিংড়ি চাষ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা প্রকাশ করেন।
কামরুল বলেন, ভেনামি জাতের চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকারীদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক হলেও আগে এ জাত চাষের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

তিনি আরও বলেন, প্রতি হেক্টরে ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন হয় ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার কেজি পর্যন্ত। অন্যদিকে প্রতি হেক্টরে প্রচলিত বাগদা চিংড়ির উৎপাদন হয় মাত্র ১ হাজার কেজি। ভেনামি চিংড়ির চাষের অনুমতি মাত্র দুই বছর আগে দেওয়া হলেও এর চাষ এখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে।

'এই খাতে যদি নতুন করে অর্থায়ন হয় এবং উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হবে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস আরও মজবুত হবে,' বলেন কামরুল।
ভেনামি চিংড়ি—যা হোয়াইট লেগড শ্ৰিম্প, প্যাসিফিক হোয়াইট শ্ৰিম্প বা মেক্সিকান হোয়াইট শ্ৰিম্প নামে পরিচিত—মূলত মেক্সিকো এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের জাত।

বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি চিংড়ির চাষ শুরু হয় ২০২১ সালে খুলনার পাইকগাছায়, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউশনের (বিএফআরআই) তত্ত্বাবধানে। প্রথম পর্যায়ে দুটি প্রতিষ্ঠান সফলভাবে ভেনামি চাষ করে।

এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সরকার ২০২২ সালে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি দেয়। এসব প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ইতিবাচক ফলাফল দেখিয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ির ব্যাপক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে এসব ফলাফল।

এপেক্স ও জেমিনির আর্থিক পারফরম্যান্স
শতভাগ রপ্তানিনির্ভর এবং আধুনিক চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা পরিচালনাকারী এপেক্স ফুডস ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ২ শতাংশ আয় কমার তথ্য জানিয়েছে। এ সময়ে তাদের আয় দাঁড়িয়েছে ১০৯.৪৫ কোটি টাকা, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে আয় ছিল ১১১.৯৩ কোটি টাকা।

কোম্পানিটি আয় কমার জন্য বিদেশের বাজারে চাহিদা কমে যাওয়াকে দায়ী করেছে।

২০২৩-২৪ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়কালে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ২০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১.৪৩ টাকা। আগের বছর একই সময়ে এ আয় ছিল ১.৭৯ টাকা।
২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির আয় ২৪ শতাংশ কমে ৫৫.৫২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৭৩.২৮ কোটি।

কোম্পানিটির মুনাফা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৮ লাখ টাকায়; যেখানে আগের বছর একই সময়ে মুনাফা ছিল ৫১ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৬৪ শতাংশ মুনাফা কমেছে।

আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, শতভাগ রপ্তানিনির্ভর প্রতিষ্ঠান জেমিনি সি ফুডস চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে। কোম্পানিটি তাদের চিংড়ির ৬৩ শতাংশ ইইউতে, ২১ শতাংশ এশিয়ায়, ১১ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে এবং ৫ শতাংশ কানাডায় রপ্তানি করে।

২০২৪ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৩.৯৪ টাকা, যেখানে আগের বছর এই সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ৪.২৮ টাকা। ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকেও কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ১.৭১ টাকা লোকসান দিয়েছে, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ৩.৭৩ টাকা।

জেমিনি সি ফুডস বলেছে, আয় হ্রাস ও গ্রস মুনাফার মার্জিন কমে যাওয়াই ইপিএস কমার প্রধান কারণ।

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
মানুষ নিজেকে ফাঁকি দিতে পারে না: প্রাথমিক শিক্ষা উপদেষ্টা Nov 09, 2025
img
শেষ মুহূর্তের গোলে পরাজয় এড়াল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড Nov 09, 2025
img
মাঝরাতে মোহাম্মদপুরে গাড়ির গ্যারেজে আগুন, নিয়ন্ত্রণে দুই ইউনিট Nov 09, 2025
img
পারমাণবিক পরীক্ষার প্রস্তাব তৈরির কাজ চলছে : রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী Nov 09, 2025
img
ফরিদপুরে মামলার পর আওয়ামী লীগের তিন নেতাকর্মী কারাগারে Nov 09, 2025
img
১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে বিএনপি : আমীর খসরু Nov 09, 2025
img
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে বিএনপির বিক্ষোভ Nov 09, 2025
img
নবীনগরে বিএনপির ২ গ্রুপের পাল্টাপাল্টি শো-ডাউন, পরিস্থিতি উত্তপ্ত Nov 09, 2025
img
এ দেশে আর কাউকে ভোট নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না : মান্নান Nov 09, 2025
img
ঝিনাইদহে গণঅধিকার পরিষদ নেতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর Nov 09, 2025
img
দেবীদ্বারে ছাব্বির হত্যাচেষ্টা মামলায় আ. লীগের ৪ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার Nov 09, 2025
img
গ্রেপ্তারের পর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে ছিনিয়ে নিল স্বজনরা Nov 09, 2025
img
১৫ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ, মধ্যরাতে প্রজ্ঞাপন জারি Nov 09, 2025
img
ভাঙ্গায় থানা ভাঙচুর মামলায় গ্রেপ্তার ১ Nov 09, 2025
img
বঙ্গোপসাগরে ইঞ্জিন বিকল, ট্রলারসহ ১৩ জেলে উদ্ধার Nov 09, 2025
img
নির্বাচন নিয়ে একটি পক্ষ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার চেষ্টা করছে : ব্যারিস্টার অসীম Nov 09, 2025
img
সালমান এখনও আমাকে হুমকি দিচ্ছেন, অভিনেত্রীর অভিযোগ Nov 09, 2025
img
বরিশালে ডেঙ্গুতে প্রাণ গেল ২ জনের Nov 08, 2025
img
দিনাজপুরে খালেদা জিয়ার আসনে প্রার্থী দেব না : নুর Nov 08, 2025
img
১৩ নভেম্বরের লকডাউন কর্মসূচি দেওয়া পাগলের প্রলাপ: সালাহউদ্দিন Nov 08, 2025