রাজনৈতিক পালাবদল: ৮ মাসে বন্ধ ১১৩ কারখানা, বেকার ৯৬ হাজার শ্রমিক

গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আট মাসে দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এবং শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ১১৩টি কারখানা। এর ফলে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৯৬ হাজার ১০৪ জন শ্রমিক।

অন্যদিকে, একই সময়ে নতুনভাবে চালু হয়েছে ১২৮টি কারখানা, যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার শ্রমিকের। ফলে নিট হিসাবে বেকার হয়েছেন অন্তত ২২ হাজারের বেশি শ্রমিক। যদিও মালিকপক্ষ বলছে, কারখানা খোলা ও বন্ধ হওয়া শিল্প খাতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তবে শ্রমিকদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা।


শিল্প পুলিশ-৪-এর তথ্য অনুযায়ী, শুধু গাজীপুরেই গত আট মাসে বন্ধ হয়ে গেছে ৫৪টি কারখানা। এই কারখানাগুলিতে কাজ করতেন প্রায় ৪৫ হাজার ৭৩২ জন শ্রমিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বেক্সিমকো গ্রুপের কারখানাগুলো, যেখানে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৩৩ হাজার ২৪৪ জন কর্মী।

গাজীপুরের বাইরে, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ২৩টি এবং সাভার-আশুলিয়ায় ১৮টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। এসব অঞ্চলে মোট চাকরি হারানো শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার।


কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক জটিল কারণ কাজ করেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, যা অর্ডারের পরিমাণে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতি এবং ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার কারণে অনেক বিদেশি ক্রেতা তাদের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন কিংবা স্থগিত রেখেছেন। এর ফলে কারখানাগুলোর উৎপাদন অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

এছাড়া, উৎপাদন ব্যয় যেমন—কাঁচামালের দাম, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য কারখানা পরিচালনা করা আর্থিকভাবে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্থ পরিশোধে বিলম্ব ঘটায় নগদ প্রবাহের সংকট তৈরি হয়, যা শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ ও উৎপাদন চালু রাখতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

রাজনৈতিক অস্থিরতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে রাজনৈতিক উত্তাল পরিবেশ, সরকার পরিবর্তন এবং কিছু কারখানায় সহিংসতার ঘটনা মালিকদের কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ীর কারখানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও রেকর্ডে এসেছে। তাছাড়া, সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত অনেক মালিক আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় তাদের মালিকানাধীন কারখানাগুলোর কার্যক্রম ধীর হয়ে যায় কিংবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে।

এই সবগুলো বিষয় মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা, যা দেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিনির্ভর খাতটির ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করেছে।

বিশেষ করে গত বছর জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পরিবর্তন এবং আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ কিছু মালিকের ব্যবসায়িক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। গাজী গ্রুপ, বেক্সিমকো, কেয়া গ্রুপসহ কয়েকটি বড় গ্রুপ এই সময় বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

বিজিএমইএ জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৫ মাসে তাদের সদস্যপদ নিয়েছে নতুন ১২৮টি কারখানা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—একেএইচ আউটওয়্যার, এজেড কম্পোজিট, এলএসএ অ্যাপারেলস, সুপ্রিম আউটফিট ইত্যাদি।

তবে এসব নতুন কারখানার বেশিরভাগই ছোট বা মাঝারি আকারের। মাত্র ১৮টি কারখানায় শ্রমিক সংখ্যা হাজারের বেশি। ফলে শ্রমিক পুনঃকর্মসংস্থানের হার সীমিত।

বাংলাদেশ সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, “কারখানা বন্ধ হয়ে এক লাখের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে এখনও নতুন কাজ পাননি। অবিলম্বে সরকারের উচিত পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া।”

তিনি আরও বলেন, “সরকারকে শ্রমিকদের জন্য আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”


বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান এবং সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান মনে করেন, বিশ্ব অর্থনীতির চাপে বিনিয়োগকারীরা আপাতত সতর্ক। তবে পুরনো কারখানাগুলো আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অর্ডার বৃদ্ধি না ঘটলে আগামী দিনগুলোতেও পোশাক খাত চাপে থাকবে।   

এফপি

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সাবেক বিচারপতিসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা Nov 05, 2025
img
টি-টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির দেখা পেল তামিম-মেহেদী Nov 05, 2025
img
পাঁচ বছরের জন্য ‘ঢাকা ক্যাপিটালস’-এর মালিকানায় শাকিব খান Nov 05, 2025
img
পুলিশের অস্ত্র উদ্ধারে আবারও পুরস্কার ঘোষণা Nov 05, 2025
img
বিমানবন্দরে আগুনের ঘটনায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা ১৫ নভেম্বরের মধ্যে: নাসিমুল গনি Nov 05, 2025
img
জাপানের ভাইস-মিনিস্টারের সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ স‌চিবের সাক্ষাৎ Nov 05, 2025
img
অর্থ আত্মসাৎ মামলায় জয়-পুতুলসহ আসামি ৮ জন Nov 05, 2025
img
লন্ডনের রাস্তায় মুগ্ধতা ছড়ালেন অপু বিশ্বাস Nov 05, 2025
img
নির্বাচনের পর ব্যারাকে ফিরে যাবে সেনাবাহিনী: মাইনুল ইসলাম Nov 05, 2025
img
নির্বাচন হলে দেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে : সেনাসদর Nov 05, 2025
img

সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রশিবির

একটি বিশেষ ছাত্রসংগঠনের মন রক্ষার্থে নির্বাচন কমিশন জকসু নির্বাচন পিছিয়েছে Nov 05, 2025
img
মামদানি বাংলাদেশি হলে তাকে ‘শাহবাগী’ ট্যাগ দেওয়া হতো: মেঘমল্লার বসু Nov 05, 2025
img
ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকে সরে দাঁড়াল বাংলাদেশ Nov 05, 2025
img
দুটি বাড়ি বিক্রি করলেন অমিতাভ বচ্চন Nov 05, 2025
img
২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরো ১০ জনের মৃত্যু Nov 05, 2025
img
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ Nov 05, 2025
img

প্রেস সচিব

এয়ার ফোর্সের সব প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ঢাকার বাইরে পরিচালনার সুপারিশ Nov 05, 2025
img
তিন দফা দাবিতে আন্দোলনে নামছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা Nov 05, 2025
img
অপরাধে জড়ালে জামিনপ্রাপ্ত আ. লীগ কর্মীদের কঠোর ব্যবস্থা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Nov 05, 2025
img
মাঠ থেকে কেন সরানো হচ্ছে সেনাবাহিনীর ৫০% সদস্য, জানা গেল কারণ Nov 05, 2025