নতুন আসা এক লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন, জায়গার অভাবে ক্যাম্পে মেলেনি ঠাঁই

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত, সহিংসতা ও খাদ্যসংকটের কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা নাগরিকদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে। গত দেড় বছরে এক লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন।

তারা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। এ অবস্থায় ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকার জায়গা সংকট দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে তাদের বসবাসের জন্য ঘর বরাদ্দ চেয়ে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর)। তবে সেই চিঠিতে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ। ফলে ক্যাম্পগুলোতে গাদাগাদি করতে থাকতে হচ্ছে নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গত দেড় বছরে এক লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসেছেন।

ইতিমধ্যে তাদের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। তাদের কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বসবাসের জন্য ঘর বরাদ্দ চেয়ে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে ইউএনএইচসিআর। গত সপ্তাহে আরআরআরসি কার্যালয়কে এ চিঠি দেয় ইউএনএইচসিআর। কিন্তু সেই চিঠির সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ। এ অবস্থায় গত দেড় বছরে আসা রোহিঙ্গাদের নতুন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছেন গত বছরের জুন-জুলাই মাসে। চলতি বছরের প্রায় প্রতিদিন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছেন বলে জানা গেছে। যেকোনোভাবে অবশ্যই অনুপ্রেবেশ ঠেকাতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরআরআরসির অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে রাখাইন রাজ্য থেকে নতুন করে পালিয়ে এসেছেন এক লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা। ইতিমধ্যে তাদের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছেন গত বছরের জুন-জুলাই মাসে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহায়তা দেওয়া হলেও তাদের জন্য ঘর বরাদ্দের বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।’

মিজানুর রহমান বলেন, ‘নতুন রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে বসবাসের জন্য ঘর বরাদ্দ দিতে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন। তবে সেই চিঠিতে সাড়া দেওয়ার পক্ষে নয় বাংলাদেশ। কারণ নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের বসতি দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তারা আপাতত যেভাবে আছে সেভাবে থাকবে। আগের ক্যাম্পগুলোতে তাদের বসতি দেওয়া যায় কিনা তা বিবেচনায় রেখেছি আমরা। তবে এটি সমাধান নয়। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ না ঠেকাতে পারলে প্রত্যাবাসন চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে।’

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। নতুন আসা এক লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা এই হিসাবের বাইরে। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, রাখাইনে আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মধ্যে সংঘর্ষ, সংঘাত, সহিংসতার কারণে অনুপ্রবেশ বেড়েছে। গত কয়েক মাসে সেখানে খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যে বুথেডং গ্রামে রোহিঙ্গা যুবকদের জোর পূর্বকভাবে দলের যোগ দিতে বাধ্য করছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। আবার রোহিঙ্গাদের হত্যা, গুম, নির্যাতন, বিদ্রোহীদের মানবঢাল ও শ্রমিক হিসেবে ব্যবহারসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদের। এসবের কারণে অনুপ্রবেশ থামছে না। সবাই পালিয়ে থাকছে।

সম্প্রতি রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে টেকনাফের শালবন আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নেওয়া রোহিঙ্গা আবদুল গফুর বলেন, রাখাইনে আরসাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে আরাকান আর্মি আমাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে। ঘরবাড়ি দখল করে রোহিঙ্গাদের গ্রামছাড়া করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ধান-চালও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা পুরুষদের ধরে নিয়ে ব্যারাক নির্মাণকাজে বাধ্য করা হচ্ছে। ঘরে ঘরে খাদ্যসংকট চলছে। আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় মাথাপিছু পাঁচ হাজার কিয়াত (মিয়ানমারের মুদ্রা, ১৮ কিয়াতে ১ টাকা) করে ঘুষ দিতে হয়েছে।

এদিকে শুধু গত সপ্তাহে বাংলাদেশে এসেছে এক হাজার ৪৪৮ রোহিঙ্গা পরিবার। এ ছাড়া আলাদাভাবে এসেছেন আরও পাঁচ হাজার ৯৩০ জন। নতুন আসা রোহিঙ্গারা ২৯ হাজার ৬০৭ পরিবারের সদস্য বলে জানা গেছে।

সেলিম উল্লাহ গত ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে টেকনাফের জাদিমুড়া এলাকায় এক স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দুই মাস হয়ে গেছে, এখনও কোনও ক্যাম্পে ঠাঁই হয়নি। আগে থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এক স্বজনের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছি। আমাদের কারণে তাদেরও থাকতে কষ্ট হচ্ছে। অনেক ক্যাম্পে খোঁজ নিয়ে দেখেছি। কোনও ক্যাম্পে থাকার জায়গা পাচ্ছি না।’

রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি মংডু টাউনশিপ সম্পূর্ণরূপে দখল করলেও সেখানে আরসা সক্রিয় রয়েছে। তারা আরাকান আর্মির ওপর অতর্কিত আক্রমণ করছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ দীর্ঘদিনের। খাদ্যসংকটের মধ্যেও আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের শ্রমিক হিসেবে কাজে বাধ্য করছে এবং তাদের বাহিনীতে নিয়োগ দিচ্ছে। অনেকে নিখোঁজ এবং কেউ কেউ নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে সেখানে নতুন করে মগ জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন করছে। তাদের এসব অত্যাচারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। তাতেও মাথাপিছু পাঁচ হাজার কিয়াত করে গুনতে হয়। আরাকান আর্মির আচরণের পরিবর্তন না ঘটলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কখনও সম্ভব হবে না। অনুপ্রবেশও ঠেকানো যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘এটা সত্য মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নতুন রোহিঙ্গাদের জন্য ক্যাম্পে কোনও জায়গা নেই। কারণ দিন দিন ক্যাম্পে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে নতুনদের জায়গা পাওয়া মুশকিল। এখানে আগে থেকে ঘনবসতি। এ অবস্থায় গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে আমাদের। তার আগে টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নিয়ে নানা চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির মুখে আছে বাংলাদেশ। তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেনদরবার চলছে। এখন প্রত্যাবাসনের বদলে আরও নতুন রোহিঙ্গা দেশে ঢোকায় চাপে পড়ছে বাংলাদেশ।’

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন গণমধ্যমকে বলেন, ‘মিয়ানমারে সংঘাতের কারণে সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করে থাকেন। সীমান্তে বিজিবি, কোস্টগার্ড সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন, যাতে নতুন করে কোনও রোহিঙ্গা ঢুকতে না পারে।’

টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘সীমান্তে বিজিবিকে কঠোর অবস্থানে রাখা হয়েছে। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির সংলগ্ন কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করে আবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে রাতে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। সেখানেও বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।’

মিয়ানমারের সিটওয়েতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম। আঞ্চলিক নিরাপত্তাবিষয়ক এই বিশ্লেষক গণমধ্যমকে বলেন, ‘একদিকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, অন্যদিকে আরাকান আর্মিও তাদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। যদি সত্যিই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ থাকতো তাহলে নতুন করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতো না। এটি প্রমাণ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসনের আশার যে কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশ সরকার কীভাবে এই জটিল বাস্তবতাকে মোকাবিলা করবে। রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে।’

এসএম/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে ‘জুলাই ঐক্য’ প্লাটফর্মের আত্মপ্রকাশ May 06, 2025
img
বাংলাদেশের শাকিব খানকে অনুকরণ করলেন শাহরুখ! May 06, 2025
img
প্রতিটি ভবন হতে হবে নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও দুর্যোগসহনশীলঃআদিলুর রহমান May 06, 2025
img
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ১ বন্ধুর, ২ জন হাসপাতালে May 06, 2025
img
খালেদা জিয়ার প্রটোকল বহরে হিটস্ট্রোকে অসুস্থ জবি ছাত্রদল নেতা May 06, 2025
img
আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেসুর রহমান গ্রেফতার May 06, 2025
img
যে কারণে ক্লাব বিশ্বকাপে দেখা যাবে না আর্সেনাল ও বার্সেলোনাকে May 06, 2025
img
সরকার প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেবে তরুণদেরঃ আসিফ মাহমুদ May 06, 2025
img
শীগ্রই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান : ডা. জাহিদ May 06, 2025
img
ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি ও তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব May 06, 2025