‘কোথাও কেউ নাই’—বলা সম্রাটের পাশে জেলা প্রশাসক

সম্রাট হোসেনের জীবনের গল্প একটি অনুপ্রেরণার প্রতীক। শৈশবে বাবাকে হারিয়ে, দারিদ্র্যের চাপে নীলফামারীর সরকারি শিশু পরিবারে আশ্রয় নিতে হয় তাকে। মা শাহিনা বেগম বুকের পাথর চেপে রেখে যান আদরের সন্তানকে, ভাবেন সেখানেই হয়তো ভালো থাকবে তার সম্রাট। সাড়ে সাত বছর বয়স থেকে সেই শিশু পরিবারের অনাথ শিশুদের ভিড়ে কাটে তার দিন। সেখানেই স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলা, হোস্টেলের ঘরে শীতবস্ত্রের অভাব, কিংবা রাতজাগা চোখের অশ্রু—সবই সম্রাটের নিত্যসঙ্গী।

তবুও থেমে থাকেননি তিনি। জেলা স্কুল থেকে এসএসসি, এরপর নীলফামারী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। এ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি।

কিন্তু ভর্তি ফি, থাকা-খাওয়ার খরচ—এসবই তো বড় বাধা। সম্রাট একটি চিঠি লিখেছিলেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহায়তায় সেই চিঠি পৌঁছায় জেলা পরিষদের হাতে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, 'কোথাও কেউ নাই'।

এই চারটি শব্দ পড়েই থমকে যান জেলা পরিষদের প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান। এরপর কিছু না ভেবেই সম্রাটকে ডেকে পাঠানো হয় পরিষদে। 'তোমার মতো সন্তানদের জন্যই আমরা আছি'—এভাবে অভয় দেন তিনি। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফি প্রদান করে সম্রাটকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিত করা হয়।

সম্রাট হোসেন নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার উত্তরা আবাসন এলাকার মৃত বাবুল হোসেনের ছেলে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সম্রাট সবার ছোট। সম্রাট এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার স্বপ্ন- ভবিষ্যতে সরকারি কর্মকর্তা হওয়া। শুধু নিজের জন্য নয়, তার মতো হাজারো শিশু পরিবারের ছেলে-মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।

সম্রাট হোসেন বলেন, ডিসি স্যারের সঙ্গে তো কেউ সহজে দেখা করতে পারেন না। আর উনি তো আমাকে নিজে থেকে ডেকে নিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এটা আমার জন্য অনেক পাওয়া। আমি পড়াশোনা শেষ করে আমার মতো অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমার পরিবারের অবস্থা ভালো না। আমার মা প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকেন। বড় ভাই শ্রমিকের কাজ করেন। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাই-বোনের মধ্যে একমাত্র আমি এ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। অনেকেই অবস্থান পরিবর্তন হলে ফেলে আসা কষ্টের কথা ইগোর কারণে ভুলে যেতে চায়। কিন্তু আমি আমার অতীতের কষ্টগুলো ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা মনে করি। আমার এতদূর আসার পথে যারা সহযোগিতা করেন তাদের অবদান কখনো ভুলব না।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত সরকারি শিশু পরিবারগুলো মূলত অনাথ, অবহেলিত বা পরিবারহীন শিশুদের আশ্রয় ও বিকাশের সুযোগ দিতে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলায় ছেলে ও মেয়ে শিশুদের জন্য পৃথক শিশু পরিবার রয়েছে। নীলফামারী সরকারি শিশু পরিবারেও বর্তমানে ৫০-এর বেশি শিশু বাস করছে।

এখানে থাকা, খাওয়া, পড়াশোনা, পোশাক ও প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা থাকলেও শিশুদের মানসিক বিকাশ এবং ব্যক্তিগত যত্নে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে মা-বাবার শূন্যতা পূরণ হয় না কোনোভাবেই। সম্রাটের মতো কেউ কেউ এসব সীমাবদ্ধতাকে জয় করে এগিয়ে যান, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন হয় একটুখানি সহানুভূতি, একটুখানি ভালোবাসা, আর সমাজের সক্রিয় সহযোগিতা।

জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর রায় বলেন, সম্রাট যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতে থাকে তখনই সমাজসেবা অধিদপ্তর আমাদেরকে জানাতে থাকে। এরমধ্যে সম্রাট সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে জেলাপ্রশাসক ও জেলা পরিষদ প্রশাসক স্যার বরাবর একটি চিঠি দেন সম্রাট। পরে স্যার তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির খরচ দিয়ে সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া আগামীতে আরও সহযোগিতা করবেন। শুধু সম্রাটই নয় তার মতো শিশু পরিবারের আরও যারা রয়েছে বা ভালো ফলাফল করছে সবাইকে আমরা সহযোগিতা করে থাকি।


এসএস/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আম কেমিক্যালমুক্ত কি না বুঝার সহজ উপায় May 14, 2025
img
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আ.লীগ নেতাকে ছিনিয়ে নিতে গিয়ে আটক ছাত্রদল নেতা May 14, 2025
img
মাদক আস্তানায় পরিণত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান : হাসনাত আবদুল্লাহ May 14, 2025
img
ফেসবুক লাইভেই গুলিবর্ষণে প্রাণ গেল মেয়র প্রার্থীর May 14, 2025
img
বহিরাগতরা কেন মারল, সাম্যের শোকার্ত বাবার প্রশ্ন May 14, 2025
img
কুষ্টিয়া স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যাচেষ্টার পর যুবকের আত্মহত্যার চেষ্টা May 14, 2025
img
ছুরিকাঘাতে ঢাবি শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় ২ জন আটক May 14, 2025
img
আম পাড়তে গিয়ে প্রাণ হারালেন বৃদ্ধ May 14, 2025
img
বাড়িতে মাদকের কারবার : মালিকসহ ৩ জনকে কারাগারে পাঠাল ইউএনও May 14, 2025
img
ঢাবি ভিসির পদত্যাগ দাবিতে ছাত্রদলের বিক্ষোভ May 14, 2025