অকালে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিল গুলতেকিনের সন্তান

প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খান একজন কবি ও সাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত। তার কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। হুমায়ূনের সঙ্গে তার বিয়ে হয় খুব অল্প বয়সে, এবং এরপর একাধিক সন্তানের মা হন তিনি। সন্তানদের বড় করার পাশাপাশি গুলতেকিন কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা শেষ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সম্প্রতি, তিনি তার ফেসবুক পোস্টে জানান যে, মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে তিনি তার সন্তানকে হারিয়েছিলেন।

কবি গুলতেকিন খানের ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

বিয়ের পর হলি ক্রস কলেজে ভর্তি হই। প্রথম বর্ষের শেষ দিকে বুঝতে পারি, আমি মা হতে যাচ্ছি। আমাদের প্রথম কন্যা নোভার জন্মের পর এইচএসসি পরীক্ষার এক-দেড় মাস আগে নোভাকে নিয়ে আমেরিকা রওনা দিই। (তবে হুমায়ূন আহমেদ ‘হোটেল গ্রেভার ইন’-এ লিখেছিলেন, তার লেখা চিঠি পড়ে আমি কাঁদতে কাঁদতে আমেরিকাতে রওনা হয়েছিলাম, সেটা সত্যি ছিল না)। সবাইকে চিঠি লিখেও যখন আমি আমেরিকা যেতে রাজি হইনি, তখন আমার দাদা প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে একটি চিঠি লেখেন তিনি।

চিঠিতে কী লেখা ছিল জানি না, তবে দাদা আমাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত রেখে বলেন, ‘বিদেশভ্রমণও শিক্ষার একটি বড় অংশ।’ দাদার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস আমার ছিল না।

যা–ই হোক, ব‍্যক্তিগত কারণে পরীক্ষার এক মাস আগে আমেরিকা চলে যাই। হুমায়ূন আহমেদের পিএইচডির পর এক বছর পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ করে আমাদের দেশে ফেরার কথা ছিল। নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে হাইস্কুলের কিছু কোর্স ছিল। আমি তিনটি কোর্স করেছিলাম, সেগুলো হলো ম্যাথ, ফিজিকস ও কেমিস্ট্রি; সবগুলোতেই ৯০ নাম্বার পেয়েছিলাম। ওঁ বলেছিল, এ ধরনের কোর্স করতে পারলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারব হয়তো। কিন্তু পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপের পাঁচ মাসের মাথায়ই ব‍্যক্তিগত কারণে দেশে ফিরে আসতে হয়। দেশে ফেরার দেড় মাসের মধ‍্যে আমাদের তৃতীয় কন্যা বিপাশার জন্ম হয় পিজি হাসপাতালে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হাসপাতালে)।

কয়েক বছর পার হয়ে ১৯৮৭ সালে নানা রকম ঝামেলা পার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কয়েক মাস পার হতেই আমি বুঝতে পারি, আবারও মা হতে যাচ্ছি। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। আমার শাশুড়িকে দেখেছি, তিনি তাঁর বড় ছেলেকে সংসারের সব ঝামেলা থেকে দূরে রাখতেন। তাই আমিও তা–ই করি। তিন কন্যা তিন স্কুলে পড়ত, অনেক ঝামেলা করে তাদের এক স্কুলে (হলি ক্রসে) এনেছি।

সকালে উঠে ওদের স্কুলের জন্য তৈরি করা বেশ কঠিন। স্কুলের কাপড় পরার পরই আমাকে দ্রুতগতিতে ৬টি বেণি করতে হয়! ওদের স্কুলে পাঠিয়ে দুপুরের খাবারের কথা ভাবতে হয়। ভাজাভুজি, ভাত, ডাল আকবরের মা রান্না করলেও মাছ, মুরগি অথবা মাংস আমাকেই রান্না করতে হয়। কন‍্যাদের বাবা রান্না ভালো না হলে খেতে পারেন না এবং প্রায়ই বন্ধুদের নিয়ে খেতে পছন্দ করেন।

আমার দাদা ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস, মা-ও ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স পড়তেন। আর আমি কি সারা জীবন ম‍্যাট্রিক পাস হয়ে থাকব? অনেক কষ্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। এখন আবার পড়াশোনা বন্ধ করতে হবে? হুমায়ূন আহমেদের তখন ৩ নম্বর ধারাবাহিক নাটক লেখার কথা হচ্ছিল। আমি তাঁকে অনুরোধ করি নাটকের কাজ কিছুদিন পরে করতে। সে রাজি হলো না, তাঁর নাকি তখনই লিখতে ইচ্ছে করছিল! আমাদের মধ্যে কথা ছিল এ রকম, তাঁর পড়াশোনার সময় আমি সাহায্য করেছি, তাই আমার পড়াশোনার সময় সে আমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু সে তাঁর কথা রাখছে না। এদিকে আমার আগের প্রেগন্যান্সিতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি। কিন্তু এবার আমার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। খাওয়া নিয়ে তো অসুবিধা হচ্ছিলই, তার সঙ্গে অন‍্য আরও কিছু উপসর্গ ছিল। একটু পরপর মুখে থুতু জমা হতো! বাসায় থাকলে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু ক্লাসের সময় কী করব? তখনো টিস্যু বক্স দেশে পাওয়া যেত না। আমি বড় একটি কাঁধে ঝোলানো ব‍্যাগে অনেক পুরোনো পত্রিকা রাখতাম, থুতু কাগজে ফেলে পলিথিনের ব্যাগে রাখতাম। শরীরের গঠনের জন্য অনেক দিন পর্যন্ত কিছু বোঝা যায়নি। তারপরও আমি খুব চওড়া সুতির ওড়না পরতাম।

হুমায়ূন আহমেদের সব নাটকের শুটিংয়ে আমি যেতাম। এবারের নাটকে আমাদের ৩ নম্বর কন‍্যাও অভিনয় করছিল। এর মধ্যে ঈদে সবার জন্য যখন নতুন কাপড় কেনা হলো, তখন চতুর্থ কন‍্যা, রাত্রির জন‍্যও জামা কেনা হলো।

হুমায়ূন আহমেদকে ইউএসআইএস থেকে আমেরিকাতে তিন মাসের জন্য পাঠানো হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে লেখক আসবেন সেখানে। তাঁর পোশাক সাধারণত আমি কিনি। স্যুটকেসের দায়িত্ব নিয়েছেন মুনির ভাবি, তাঁরা নিউমার্কেটের খুব কাছে থাকেন (যদিও ‘মে ফ্লাওয়ার’, হুমায়ূন আহমেদের ব‍্যক্তিগত জীবন নিয়ে লেখায় ‘স্যুটকেস আমার কেনা’ লিখেছেন)।

হুমায়ূন আহমেদ তখন খুবই ব্যস্ত; কারণ, তিন মাসের নাটক লিখে, অভিনয় পর্বগুলো দেখে তিনি যাবেন। আমাকেও নাটক পড়ে দেখতে হবে আগের পর্বগুলোর রিপিটেশন যেন না থাকে।

আমার কন‍্যার জন্মের তারিখ পার হয়ে গেছে (প্রতিবারই এমন হয়), আমরা দুজনই ডাক্তারের কাছে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ডাক্তার সাহেব, আর কিছুদিন পরই আমি দেশের বাইরে যাব। আমি কি বাচ্চাকে দেখে যেতে পারব না? ডাক্তার সাহেব বললেন, কালকে সকাল ৮টার মধ্যে আমার ক্লিনিকে চলে আসবেন।

তত দিনে একজন প্রকাশক লেখককে একটি গাড়ি কিনে দিয়েছেন। আমি ৮টার অনেক আগেই রেডি। একটু পরপর বলছি, ৮টা প্রায় বেজে যাচ্ছে। অবশেষে আমরা ক্লিনিকে পৌঁছালাম ৮টা ৫ মিনিটে। ডাক্তারের নির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট পর! শুনলাম, উনি ঠিক ৮টায় চলে গেছেন। আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন নাটকের আউটডোর শুটিংয়ে। কয়েকজন অল্প বয়সী ডাক্তার এবং নার্স কিছুক্ষণ পরপর আমার পালস, হার্টবিট এবং বাচ্চার হার্টবিট চেক করছেন। সাড়ে ১১টার দিকে একজন ডিউটি ডাক্তার অথবা নার্স ডাক্তারকে ফোন করে বললেন, বাচ্চার হার্টবিট ইরেগুলার!

আমার সাথে আত্মীয়স্বজন কারা ছিলেন, কিছুই মনে পড়ছে না। কারণ, সকাল থেকেই আমার কিছু ভালো লাগছিল না! কেন যেন খুব মন খারাপ লাগছিল। শুনলাম, ডাক্তার সাহেব ২টা থেকে ৩টার মধ্যে এসে অপারেশন করবেন। উনি এলেন রাত ৯টার দিকে। ততক্ষণে হুমায়ূন আহমেদ আউটডোরের কাজ শেষ করে দলবল নিয়ে ক্লিনিকে চলে এসেছেন। এর পরের ঘটনা আমার তেমন মনে নেই, শুধু মনে আছে, আমাকে কেউ একজন ইনজেকশন দিয়েছেন।

মাঝরাতে মনে হলো, একটি পুরুষ কণ্ঠে কেউ বলছেন, এই যে শুনতে পাচ্ছেন? আপনার তো ছেলে হয়েছে! তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ি!

সকালে ঘুম ভাঙে, দেখি, চেয়ারে বসে আছেন লেখক সাহেব। আমার খুব কাছে এসে বললেন, ‘গুলতেকিন, তোমার তো রাজপুত্রের মতো ছেলে হয়েছে! কী চাও তুমি?’ আমি ক্লান্ত গলায় বলি, ‘কিছু না।’

‘তোমাকে খুব সুন্দর একটা ডায়মন্ডের আংটি কিনে দেব!’ আমি মনে মনে ভাবি, ‘ছেলে হলে কেন ডায়মন্ডের আংটি দেবে?’

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর একজন নামকরা ডাক্তার আমার পাশের চেয়ারে বসেন। বলেন, ‘আপনি বোধ হয় শুনেছেন, আপনার ছেলে এমএএসে ভুগছে! আমরা একটি মেডিকেল বোর্ড তৈরি করেছি। কিন্তু আপনি তো তার “মা”, তাই আপনিও ওর কাছে বসে একটু দোয়া করেন!’

আমি কিছু না বুঝে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকি। উনি আমাকে বুঝিয়ে বলেন। অনেক সময় বাচ্চারা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি যদি মায়ের পেটে থাকে, তখন একটি খাবার খায়। ওই খাবারটি তার নিজের পুপ! বেশি খেয়ে ফেললে এবং সাকশন মেশিন দিয়ে তখনই বের না করলে বাচ্চার অবস্থা খুব খারাপ হয়! মেডিকেল টার্মে এটাকে বলা হয় ‘ম্যাকুনিয়াম অ্যাসপিরেশন সিনড্রোমা’। উনি মাথা নিচু করে বসে থাকেন।

আমি ধীরে ধীরে উঠে বসি। একজন নার্সকে বলি আমাকে বাচ্চার কাছে নিয়ে যেতে। আমি হেঁটে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠি। বিশাল একটি ঘরে ছোট্ট একটি কাচঘেরা বাক্সে ঘুমিয়ে আছে আমার ছেলে! আমি তাকে ছুঁতে চেষ্টা করি কিন্তু পারি না! কী দোয়া করব আমি? ফিরে আসি অন‍্য একটি ঘরে। তিন দিন বয়সে ব্রেন হোমারেজে সে চলে যায় না–ফেরার দেশে! এই তিন দিনে আর কী কী হয়েছিল, আমি জানি না। শুধু মনে আছে, আমার কোলে একটি ধবধবে সাদা টাওয়াল রাখা হয়েছিল। তারপর আমি নিজেকে আবিষ্কার করি আমার পরিচিত ঘরে।

তিন দিন পর তার কুলখানি হয়। বাসাভর্তি মানুষ, আত্মীয়স্বজন ছাড়াও অভিনয়জগতের অনেক মানুষ। আমাকে কুলখানির তেহারি দেয়, নিজের ছেলের কুলখানির খাবার আমি খেতে পারিনি, আমার বমি আসে।
আমার ঘরে একা বসে থাকি। একেকজন একেক রকম সান্ত্বনা দেয়। একজন বলেন, নিষ্পাপ শিশু মারা গেলে বেহেশতে যায় এবং মাকেও সাথে নিয়ে যায়।

আমি সারা দিন বিছানায় বসে ভাবি, আমি জেনেশুনে কখনো কোনো অন‍্যায় করিনি! আল্লাহর কাছে ছেলেও চাইনি! কেন আল্লাহ আমাকে তাহলে এত কষ্ট দিলেন?

হুমায়ূন আহমেদ চলে যান আমেরিকাতে। আর তিন–চার দিন পর আমার ফার্স্ট ইয়ার পরীক্ষা!

পরীক্ষার দিন, বাচ্চারা সবাই স্কুলে। আমি বসে ভাবতে থাকি, কী করা উচিত? আমি বেস্ট ফ্রেন্ড রিংকুকে ফোন করি।

: রিংকু, তুমি পরীক্ষা দিতে যাবার সময় আঙ্কেলকে বলো আমাকেও তুলে নিতে!
: সত্যি আপনি যাবেন?
: হ‍্যাঁ, যাব। যদি বসে থাকতে হয়, তাহলে বসেই থাকব! তবে একটি শর্ত আছে! আমার রোল নাম্বার তোমার চেয়ে চারজনের পর। আমি তোমার পেছনে বসব কিন্তু তুমি কখনো পেছন ফিরে তাকাবে না!
: কেন?
: পরে বলব।

আমরা চারতলায় যাব।

ইতিমধ্যেই আমার খবর ছড়িয়ে গিয়েছে। আমাকে চারতলায় যেতে দেবে না কেউ! নিচে সিক বেডে বসে পরীক্ষা দিতে বলছেন সবাই।

আমি হেঁটে হেঁটে চারতলায় গিয়ে সিট নাম্বার মিলিয়ে বসি।

চারটা প্রশ্নের উত্তর লেখার কথা। আমি লিখছি আর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। কেন, তা জানি না!

চারটার থেকে সাড়ে তিনটার উত্তর লিখলাম। তারপর পেছনের সিঁড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিচে নামলাম!

আমার সন্তানেরা যেন আমাকে দেখে শেখে যে জীবনে যতই ঝড় আসুক, পড়াশোনা শেষ করতেই হবে!

আরএ/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ টর্নেডোতে নিহত ২১, ক্ষতিগ্রস্ত হাজারো ঘরবাড়ি May 17, 2025
img
জন্মদিনে আরও কাছাকাছি বনি-কৌশানী May 17, 2025
img
শুরু হচ্ছে অভিযান; মোদির নতুন নিয়মে ভারত ছাড়তে হবে পলাতক আ. লীগ নেতাদের ! May 17, 2025
img
বাহরাইনের মন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ May 17, 2025
img
সরকারের ভেতরে-বাইরে অস্থিরতা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে : তারেক রহমান May 17, 2025
img
ছেলেকে থানায় দিয়ে বিএনপি নেতার ফেসবুকে পোস্ট May 17, 2025
img
সিরাজগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা গ্রেফতার May 17, 2025
img
২৩ লাখ টাকায় বিক্রি হলো কুকুর-হরিণের মতো দেখতে ‘বিরল’ ছাগল May 17, 2025
img
পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্টে সর্বোচ্চ ফি ৩০০ টাকা: বাংলাদেশ ব্যাংক May 17, 2025
img
মেহজাবীনের নতুন সুখবর May 17, 2025