হত্যাচেষ্টা ও চাঁদা দাবির মামলায় আসামি হানিফ মেম্বারের জামিন আবেদন নাকচ করায় ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুনাইদকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপিপন্থী কয়েকজন আইনজীবী। একইসঙ্গে তাকে উদ্দেশ করে গালিগালাজও করেছেন তারা। শনিবার (১৭ মে) দুপুরে আদালত কক্ষে এ ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যা প্রচেষ্টা মামলায় আসামি হানিফ মেম্বার গত ১২ মে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। বিচারক সেই আবেদন খারিজ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর গত বৃহস্পতিবার পুনরায় জামিন আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। শনিবার সেই আবেদনের শুনানি শেষে আদালত তা নামঞ্জুর করলে আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।
ঘটনার বিষয়ে আদালতের বেঞ্চ সহকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, খোরশেদ আলমসহ কয়েকজন আইনজীবী হানিফ মেম্বারের পক্ষে শুনানি করেন। জামিন না মঞ্জুর করায় তারা বিচারকের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ফ্যাসিবাদের দোসর, দালাল ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন। এমনকি আদালতের কার্যতালিকা ছুড়ে ফেলেন। তিনি বলেন, বিচারক আইনানুযায়ী জামিন নামঞ্জুরের আদেশ দেন এবং পুনরায় শুনানির প্রয়োজন হলে সিজেএম বরাবর স্পেশাল পুটআপের পরামর্শ দেন। কিন্তু আইনজীবীরা তা না করে জোর করে শুনানি চালিয়ে যেতে চান। এ সময় বিচারকের সঙ্গে তারা অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন এবং হুমকি দেন।
বিচারক ও আইনজীবীদের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, সিনিয়র আইনজীবী খোরশেদ আলম বিচারককে বলেন, ‘ঘটনার তারিখ, সময় ও স্থান এক—এটা কিভাবে দুইটি মামলা হয়?’ এরপর তিনি এজলাস ত্যাগ করেন।
ঘটনার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন আরও কয়েকজন আইনজীবী। তাদের মধ্যে আবদুল খালেক মিলন নামের একজন বলেন, ‘আমরা আজ কথা বলছি, যদি ৫ আগস্ট সরকার ব্যর্থ হতো, আমরা হয়তো গুম কিংবা খুন হয়ে যেতাম। আমরা সিএমএম কোর্টে রাজনীতি করেছি। ৮০ বছরের একজন লোক আত্মসমর্পণ করেছে।’ এ সময় আরেক আইনজীবী বলেন, ‘আমরা শুনানি করে চলে এসেছি। বিচারক জিআরওকে বলছেন, আপনি ভয় পেয়েছেন। আমরা কি কোনো ভয় দেখিয়েছি?’
আবদুল খালেক মিলন আরও বলেন, ‘শোনেন স্যার, বলতে খারাপ লাগে—আমাদের কারণেই আপনি এই চেয়ারে বসে আছেন। নইলে এই জায়গায় আপনি থাকতেন না। আমরা ১৭ বছর ধরে যে কষ্ট করেছি... ৪ আগস্টের ভিডিও ফুটেজ দেখেন। আমরা কোনো অন্যায় আবদার করিনি। ৫ আগস্টের পর থেকে আর কোনো কোর্টে তদবির করিনি। সবাই বলছে, আমি না।’
আইনজীবীরা তখন বলেন, ‘আমরা আবার জামিনের আবেদন করবো, আপনি আগামীকাল শুনানির জন্য দিন ধার্য করুন।’
বিচারক তাদের বলেন, ‘আপনারা সিজেএম স্যারের কাছে স্পেশাল পুটআপ দিন।’ তবুও এক আইনজীবী বলেন, ‘আপনি কাল একটা ডেট রাখেন, তাহলে আমরা বাঁচতে পারি। না হলে আমরা কেউই বাঁচতে পারবো না।’
এ সময় কেউ একজন বলেন, ‘যান যান।’ তখন এক আইনজীবী ধমকের সুরে বলেন, ‘চুপ।’ পরে তারা বিচারককে ‘আওয়ামী লীগের দালাল’ বলে গালি দেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুল খালেক মিলন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার আমরা হানিফ মেম্বারের জামিন আবেদন করি। শনিবার শুনানির পর তা নামঞ্জুর হয়, আমরা চলে আসি। কিন্তু বিচারক পরে জিআরওকে ধমক দেন, বলেন আপনি ভয় পেয়েছেন কি না জামিনের বিরোধিতা করতে। তখন জিআরও আমাদের সাপোর্ট করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বলেছি, যদি জামিন না মঞ্জুর হয় তাহলে আমরা রিকলের আবেদন করবো। কিন্তু বিচারক শুনেননি, পিটিশন রাখেননি। বরং জিআরওকে ধমক দিয়েছেন।’
এদিকে মামলার বাদী ফজলুল হক বলেন, ‘হানিফ মেম্বার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। শাক্তা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে টানা ১৫ বছর নির্বাচন ছাড়াই মেম্বার ছিলেন। জমি দখল করতেন, নৌকা বাইতেন, বৃষ্টিতে ভিজতেন। এখন তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। বহু মানুষের জমি দখল করেছেন, মসজিদের জমি জালিয়াতি করে বিক্রি করেছেন। এক পাগলের ২৪ শতাংশ জমিও জাল করে বিক্রি করেছেন। তিতাস গ্যাসের লাইন এনে দেওয়ার নামে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। পরে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ সেই লাইন কেটে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি যখন হজে ছিলাম, তখন আমার বিরুদ্ধে ধর্ষণসহ আরও দুটি মামলা করেছেন। আমার দুটি প্লট রয়েছে। একটির মালিক এখন জেসমিন। অন্যটিতে আমি থাকি। জেসমিনের ধানমন্ডির বাসা ভাঙচুর করে লুটপাট চালানো হয়। আমার জমিও দখলের চেষ্টা করেন। কেয়ারটেকারকে মারধর করেন, তার স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করেন। আমি মামলা করেছি। এখন হানিফ জেল থেকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। একবার আদালতে জামিনের বিরোধিতা করতে গিয়ে উকিলদের হুমকির মুখে পড়েছি।’
তিনি আরও জানান, ‘গত ৬ মে আমি হানিফ মেম্বারসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ৭০-৮০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেছি। মামলায় অভিযোগ, কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নের আরশিনগরে আমার ১৩ শতাংশ জমির ওপর বাড়ি রয়েছে। আসামিরা তা দখলের চেষ্টা করছে। ২৫ ও ২৭ জানুয়ারি তারা আমাকে গালিগালাজ করে এবং জমি ছেড়ে দিতে বলে। জমি না ছাড়লে খুনের হুমকি দেয়। ২৯ জানুয়ারি আমি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি। ৫ মে তারা আমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে কেয়ারটেকারকে হত্যার উদ্দেশ্যে হাত-পা বেঁধে ফেলে। আমার স্ত্রী বাধা দিলে তাকেও শ্লীলতাহানি করে। দেয়াল ভেঙে জিনিসপত্র লুটে নেয়। এতে আমার ১০-১১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। এ সময় তারা এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে।’
এসএস/এসএন