বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর—এই চিরন্তন প্রবাদের প্রতিধ্বনি যেন অনুরণিত হয় ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অসাধারণ সিনেমা লাইফ অফ পাই-তে। সায়েন্স-ফিকশন কিংবা সুপারহিরো নির্ভর সিনেমার ভিড়ে এটি এক ব্যতিক্রম, যেখানে বিশ্বাস, প্রেরণা ও সাহসিকতা মিলিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এক অনন্য গল্প। চলুন, জেনে নিই বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এ সিনেমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কিছু অজানা দিক।
গল্পের পেছনের গল্প
এই সিনেমার চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছে ইয়ান মার্টেলের ২০০১ সালে প্রকাশিত লাইফ অফ পাই উপন্যাস থেকে।মার্টেল এই বই লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান লেখক মোয়াসির স্কিয়ার-এর উপন্যাস ম্যাক্স এন্ড দ্য ক্যাটস থেকে। সেই সঙ্গে কুরআন, বাইবেল ও গীতা সহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, প্রাণীর আচরণ এবং বাস্তব নৌ-দুর্ঘটনার উপরও বিস্তর গবেষণা করেছিলেন লেখক।
পরিচালক নির্বাচনের ঘাত-প্রতিঘাত
প্রথমে এই সিনেমা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল এম. নাইট শ্যামলান ও পরবর্তীতে আলফনসো কুয়ারন-এর হাতে। কিন্তু নানা কারণে তারা সরে দাঁড়ানশেষমেশ অ্যাং লি ২০০৯ সালে পরিচালনার দায়িত্ব নেন এবং অসাধারণ দক্ষতায় সিনেমাটি রূপ দেন এক শিল্পকর্মে।
অভিনয়ে লটারির টিকিট
মূল চরিত্রে অভিনয় করা সুরাজ শর্মার সিনেমায় আসা একেবারেই কাকতালীয়। তিনি আসলে অডিশনে গিয়েছিলেন তার ভাইকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু কাস্টিং ডিরেক্টরের নজর পড়ে তার উপরই।যদিও সাঁতার জানতেন না, তাকেই বেছে নেওয়া হয় পাই প্যাটেল চরিত্রে।
ইরফান খানের অসাধারণ সংযোজন
বয়স্ক পাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করা ইরফান খান-এর সিনেমায় যুক্ত হওয়ার গল্পও অনন্য। কাস্টিং ডিরেক্টরের ফোনে তিনি অ্যাং লির সঙ্গে দেখা করেন এবং তারই আগ্রহে এই চরিত্রে যুক্ত হন। অভিনয়ের জন্য তিনি বইটি বারবার পড়ে চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করেন।
বাস্তব জীবনের পাই
সিনেমায় সমুদ্রে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের পরামর্শদাতা ছিলেন স্টিভ ক্যালাহান।যিনি ৭৬ দিন আটলান্টিকে একা একটি লাইফবোটে কাটিয়েছিলেন। তার অভিজ্ঞতাই সিনেমার বাস্তবতাকে আরো জীবন্ত করেছে।
রিচার্ড পার্কারের নামের রহস্য
সিনেমার বাঘটির নাম রিচার্ড পার্কার নেওয়া হয়েছিল ইতিহাস ও সাহিত্যের প্রেক্ষিতে। বিখ্যাত লেখক এডগার অ্যালান পো-র গল্প ও ১৮৮৪ সালের জাহাজডুবির এক বাস্তব ঘটনার সাথেও এই নামটি জড়িত।
গাণিতিক যোগাযোগ
পাই লাইফবোটে কাটিয়েছিল ২২৭ দিন, যা ২২ ÷ ৭ করলে পাইয়ের গাণিতিক মান (π = ৩.১৪) নির্দেশ করে—একটি চমৎকার প্রতীকী সংযোগ।
স্পাইডারম্যানের সংযোগ
মূলত লেখকের চরিত্রে অভিনয়ের কথা ছিল টবি ম্যাগুয়্যারের। কিন্তু সংক্ষিপ্ত স্ক্রিনটাইমের কারণে অ্যাং লি তাকে বাদ দিয়ে রেইফ স্পল-কে চূড়ান্ত করেন।
বিশ্বব্যাপী দৃশ্যায়ন
পন্ডিচেরি ও কেরালার মুন্নার ছাড়াও সিনেমার বড় একটি অংশের দৃশ্যধারণ হয় তাইওয়ানের ওয়েভ ট্যাঙ্ক-এ, যেখানে পানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১.৭ মিলিয়ন গ্যালন।
ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের জাদু
ভিএফএক্সের মাধ্যমে সমুদ্রকে একটি চরিত্রে পরিণত করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন দেশের টিম একত্রে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
সমালোচনা ও বিতর্ক
যদিও সিনেমাটি দর্শকের ভালোবাসা কুড়িয়েছে, তবু সমালোচনার বাইরে ছিল না। একটি বাঘ প্রায় ডুবে যাওয়ার ঘটনায় প্রাণীপ্রেমীরা প্রতিবাদ জানায়। এছাড়া সিনেমার একটি গানের বিরুদ্ধে প্ল্যাজারিজম-এর অভিযোগ ওঠে।
বক্স অফিসে বাজিমাত
মাত্র ১২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি হলেও সিনেমাটি বিশ্বব্যাপী ৬০৯ মিলিয়ন ডলার আয় করে। পেয়েছে ১০১টি মনোনয়ন, জিতেছে ৪৬টি পুরস্কার, যার মধ্যে রয়েছে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা পরিচালক ও ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসহ চারটি পুরস্কার।
শেষ কথায়
লাইফ অফ পাই কোনো সাধারণ সিনেমা নয়—এটি এক আত্মিক যাত্রা, যেখানে বিশ্বাসই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যে গল্প একাকিত্বকে সাহসে রূপান্তর করে, আর বাস্তবতাকে ছুঁয়ে ফেলে কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে।
এফপি/এসএন