পৃথিবীর শ্বাসযন্ত্র আমাজন আজ হুমকির মুখে

আমাজন অরণ্য—যাকে আমাজন জঙ্গল বা আমাজোনিয়া নামেও ডাকা হয়—পৃথিবীর বৃহত্তম এবং সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যময় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বর্ষাবন। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী বিধৌত এই বিশাল বনভূমি প্রায় ৭,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, যার মধ্যে প্রায় ৬,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার ঘন বনাঞ্চল। এর বিশালতা কেবল আয়তনে নয়; বরং জীববৈচিত্র্য, পরিবেশগত গুরুত্ব এবং মানবজাতির অস্তিত্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কের কারণেই এটি অমূল্য। উল্লেখযোগ্য যে, পৃথিবীর মোট অবশিষ্ট বর্ষাবনের অর্ধেকের বেশি একাই এই অরণ্য ধারণ করে।

‘আমাজন’ নামটির উৎপত্তি গ্রীক পুরাণের নারী যোদ্ধা ‘আমাজন’ থেকে, যাদের সাহস ও শক্তি কিংবদন্তির অংশ। ষোড়শ শতাব্দীতে স্প্যানিশ অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো ডি ওরেলানা এই অঞ্চল অনুসন্ধানকালে স্থানীয় নারী যোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন এবং তাদের তুলনা করেন গ্রীক পুরাণের আমাজনদের সঙ্গে। সেখান থেকেই এই জঙ্গল ‘আমাজন’ নামে পরিচিতি পায়।

এই অরণ্য নয়টি দেশজুড়ে বিস্তৃত—ব্রাজিল, পেরু, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানা। এর মধ্যে সর্ববৃহৎ অংশ, প্রায় ৬০ শতাংশ, ব্রাজিলে অবস্থিত। এখানে প্রায় ৩ কোটি মানুষ বসবাস করে, যাদের মধ্যে ৯ শতাংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠী। স্বীকৃত আদিবাসী এলাকার সংখ্যা ৩,৩৪৪টি এবং প্রায় ৬০টি জনগোষ্ঠী এখনো বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্নভাবে জীবন যাপন করে। এই বৈচিত্র্য শুধু সাংস্কৃতিক নয়, পরিবেশগত ভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমাজনের জীববৈচিত্র্য পৃথিবীর জন্য এক অসামান্য সম্পদ। এখানে রয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। অনন্য এবং কখনো কখনো ভয়ংকর এসব প্রাণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অ্যানাকোন্ডা, জাগুয়ার, বৈদ্যুতিক ইল, পিরানহা, বিষাক্ত ডার্ট ফ্রগ এবং লাল চোখা ব্যাঙ। আমাজন নদীতে বাস করে ৩০০০-এরও বেশি প্রজাতির জলজ প্রাণী ও মাছ। এই জীবজগৎ কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস নয়, বরং বৈশ্বিক জৈবচক্রেও অবদান রাখে।

আমাজনের বনে রয়েছে প্রায় ১৬ হাজার প্রজাতির ৩৯০ বিলিয়ন গাছ। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর কারণে অধিকাংশ গাছ চিরহরিৎ এবং এখানকার গড় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা অত্যধিক। উচ্চ বাষ্পীভবনের কারণে এই বন নিজেই একটি আর্দ্র মাইক্রোক্লাইমেট তৈরি করে। এ কারণে আমাজনকে শুধু রেইনফরেস্ট নয়, “পৃথিবীর ফুসফুস” বলা হয়—কারণ এটি বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন তৈরি করে। গবেষণায় জানা গেছে, আমাজন প্রতিবছর প্রায় ২০ বিলিয়ন টন অক্সিজেন উৎপন্ন করে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কিন্তু এই অরণ্য এখন ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। বন উজাড়, অবৈধ খনিজ আহরণ, কৃষি সম্প্রসারণ, নির্বিচারে কাঠ কাটা এবং পরিবেশবিরোধী নীতির কারণে আমাজনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে ব্রাজিলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বন উজাড়ের ফলে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি এই উজাড় থেকে উৎপন্ন সব পণ্যের সম্মিলিত মূল্যের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি। একই বছরে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে পরামর্শ দেওয়া হয়, বন রক্ষা করেও একটি টেকসই অর্থনীতির মডেল গড়ে তোলা সম্ভব। অপরদিকে, পেনসিলভানিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জেমস এলকক সতর্ক করেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে আমাজন অরণ্য পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে।

এই অরণ্য এখন আর কেবল দক্ষিণ আমেরিকার গর্ব নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক পরিবেশ রক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। জলবায়ু সংকট আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে আমাজনের অস্তিত্ব রক্ষা শুধু পরিবেশবিদদের কাজ নয়, বরং প্রতিটি সচেতন মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। বন উজাড়, বন্যপ্রাণী নিধন এবং প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে আজ বিশ্ববাসীকে একযোগে রুখে দাঁড়াতে হবে। কারণ, আমাজন যদি হারিয়ে যায়, তবে পৃথিবী শুধু তার ‘ফুসফুস’ নয়, ভবিষ্যতের জীবনের এক বিশাল সম্ভাবনাও হারাবে।

এসএম

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আরিয়ানের বিরুদ্ধে মামলা করায় বিপাকে সমীর ওয়াংখেড়ে Oct 12, 2025
img
আফগানদের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক সিরিজ হার বাংলাদেশের Oct 12, 2025
img
বিমানবন্দর সড়কে নতুন ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম! Oct 11, 2025
img
বিএনপি সরকারে এলে জিডিপির ৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করবে : শামা ওবায়েদ Oct 11, 2025
img
জুলাই অভ্যুত্থানের পর সাংবাদিকদের অবারিত স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে: আজাদ মজুমদার Oct 11, 2025
img

সামান্তা শারমিন

শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যাগুলোকে আইডেন্টিফাই করতে হবে Oct 11, 2025
img
রোববার থেকে দেশে প্রথমবারের মতো টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন শুরু Oct 11, 2025
img
মাচাদোকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ায় তীব্র নিন্দা ইরানের Oct 11, 2025
img
জামায়াত সৎ মানুষদের মনোনয়ন দিয়েছে : এটিএম আজহার Oct 11, 2025
img

জিল্লুর রহমানের বিশ্লেষণ

আবারও ভেল্কিবাজি, রাজনীতিতে কালো ছায়া Oct 11, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিলো চীন Oct 11, 2025
img
গাজায় চালু হচ্ছে ব্যাংকিং কার্যক্রম Oct 11, 2025
অনুশীলনের মাঝেই ৬ কোটি টাকার ক্ষতি রোহিতের Oct 11, 2025
ব্যারিস্টার নুসরাতের হাতে আংটি পরালেন ইশরাক Oct 11, 2025
কি কারণে রাকসু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন ক্রীড়া সম্পাদক প্রার্থী? Oct 11, 2025
নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হলে ভিন্নমত বিশেষজ্ঞদের! Oct 11, 2025
চাকরি হারিয়ে যা বলছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা! Oct 11, 2025
img
এনসিপি দ্বায়িত্বে এলে দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করা হবে: সারজিস Oct 11, 2025
img
৩ ট্রিলিয়ন ডলারের হালাল বাজারেও পিছিয়ে বাংলাদেশ Oct 11, 2025
img
আওয়ামী লীগকে দলে ভেড়াতে সব দল উঠেপড়ে লেগেছে : ডিআইজি পলাশ Oct 11, 2025