শারীরিক, আর্থিক সামর্থ্য সমন্বিত ইবাদত হজ ইসলামের পঞ্চভিত্তির অন্যতম এবং ফরজ ইবাদত। আরবি হজ শব্দের অর্থ সংকল্প করা বা ইচ্ছা করা। হজ লাখো মানুষের চলমান মহাসমাবেশ এবং আরাফাহ, মুজদালিফা, মিনা প্রভৃতি স্থানে যথাসময়ে সুশৃঙ্খল কর্মসম্পাদনের মহাপ্রশিক্ষণ। অগণন মানুষ এখানে সমবেত হন, যাঁদের পরনের কাপড় এক, কামনা এক, মনে-মুখে ধ্বনিত হয় একই ভাষার একই উচ্চারণ—‘লাব্বাইক! আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! (উপস্থিত! হে প্রভু আমি উপস্থিত!)।
ইবরাহিম (আ.)-কে আবুল আম্বিয়া বা নবীদের পিতা বলা হয়। তিনিই মুসলিম মিল্লাতের প্রতিষ্ঠাতা “...এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের মিল্লাত। তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৭৮)
হজ নবীদের স্মৃতিবিজড়িত ইবাদত।
নানা আনুষ্ঠানিকতায় প্রিয় নবী (সা.)-এর আগেও হজের প্রচলিত ছিল। আইয়ামে জাহিলিয়াতে নগ্ন তাওয়াফসহ মক্কাবাসীরা কাবার চারপাশে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন এবং সেগুলোর উপাসনা, হজের মূলনীতির বিকৃতি ঘটায়।
নবী-রাসুলের হজ
ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক, হায়তামি ও ইবনে কাসির (রহ.)সহ বেশির ভাগ বিশ্লেষকের মতে, হুদ ও সালেহ (আ.) ছাড়া প্রায় সব নবী-রাসুল হজ করেছেন। (সিরাতে ইবনে ইসহাক, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।
নবীদের হজসংক্রান্ত বিবরণ—
আদম-হাওয়া (আ.)
আদম (আ.), হাওয়া (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর, অবশেষে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হন। ঘটনাটির কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আদমের বংশধর প্রতিবছর আরাফাতের প্রান্তরে কান্নাকাটির মাধ্যমে মহাপ্রভুর দরবারে উপস্থিতি নিশ্চিত করেন।ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, আদম (আ.) বেহেশত থেকে ভারতবর্ষে অবতরণ করেন। সেখান থেকে তিনি ৪০ বার পদব্রজে হজ করেন।
ইবরাহিম (আ.) ও বিবি হাজেরা
ইবরাহিম (আ.) ও বিবি হাজেরা এবং তাঁদের সন্তান ইসমাঈল (আ.)-এর সাফা-মারওয়া সাঈ, মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ এবং কোরবানি আদায়ের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য হজের প্রচলন করেন।
হজ সম্পর্কে অসংখ্য বর্ণনা পাওয়া যায় বিভিন্ন সুরায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন আমি ইবরাহিমকে সেই ঘরের (বায়তুল্লাহ) স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম...আর মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূরপথ পাড়ি দিয়ে। ....তারপর তারা যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়, তাদের মানতসমূহ পূরণ করে এবং প্রাচীন ঘরের (বায়তুল্লাহ) তাওয়াফ করে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ২৬-২৯)
মুসা (আ.) এবং ৭০ জন নবী
রাসুল (সা.) বলেন, রাওহা উপত্যকা দিয়ে ৭০ জন নবী পশমি কাপড় পরে হজ করতে গিয়েছিলেন এবং মসজিদে খায়ফে তাঁরা সালাত আদায় করেছিলেন। (বায়হাকি, মুসতাদরাকে হাকেম)
রাসুল (সা.) আরো বলেন, মসজিদে খায়ফে ৭০ জন নবী সালাত আদায় করেছেন। মুসা (আ.) তাঁদের অন্যতম...তাঁর গায়ে দুটি পশমি চাদর জড়ানো। তিনি দুই গুচ্ছ লাগামবিশিষ্ট উটের ওপর ইহরাম বেঁধে বসে আছেন। (তাবরানি)
সুলায়মান (আ.)
বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণের পর সুলায়মান (আ.) মক্কায় হজব্রত পালন করেন বলে কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। মক্কায় আবস্থানকালে তিনি প্রতিদিন পাঁচ হাজার পাঁচ হাজার করে উট, গরু, ছাগল কোরবানি করেন।
ঈসা (আ.)
ঈসা (আ.)-এর হজের কথাও হাদিসে পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ! মরিয়মপুত্র ঈসা অবশ্যই রাওহা উপত্যকায় হজ অথবা ওমরাহ অথবা উভয়ের তালবিয়া পাঠ করবেন।’ (মুসলিম)
মুহাম্মদ (সা.)
প্রিয় নবী (সা.) চারবার ওমরাহ, হিজরতের পর একবার ফরজ হজ করেছেন। কাতাদা (রহ.) বলেন, আমি আনাস বিন মালিক (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসুল (সা.) কতবার হজ করেছেন? তিনি বলেন, একবার। আর ওমরাহ করেছেন চারবার। জিলকদ মাসে একবার। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় একবার। হজের সঙ্গে একবার। আর একবার যখন তিনি হুনাইন জিহাদের গনিমতের মাল বণ্টন করেছেন।’ (সুনানে তিরমিজি)
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, হিজরতের আগে রাসুল (সা.) দুইবার হজ করেছেন। যেমনটি তিরমিজি শরিফের একটি দুর্বল বর্ণনায় রয়েছে। আবার কেউ কেউ হিজরতের পূর্বে প্রতিবছরই হজ করার কথা উল্লেখ করেছেন।
পরিশেষে নিবেদন, মহান আল্লাহ সবাইকে নবী-রাসুলদের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র কাবাঘর জিয়ারত ও হজের তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমআর