সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতি গ্রাম ৪০০ দিরহামের গণ্ডি অতিক্রম করেছে, যা দেশটির বাজারে একটি নতুন ধারা সূচিত করেছে। বিশ্লেষক ও খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, এটি শুধু একটি সাময়িক ঊর্ধ্বগতি নয়, বরং মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে এই দামই হতে চলেছে ‘নতুন স্বাভাবিক’।
বুধবার (২৮ মে) সন্ধ্যায় দুবাইয়ের বাজারে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ প্রতি গ্রাম ৪০০.২৫ দিরহামে লেনদেন হয়েছে, আর ২২ ক্যারেটের দাম ছিল ৩৭০.৭৫ দিরহাম। বৈশ্বিক বাজারে প্রতি আউন্স স্পট গোল্ডের মূল্য ছিল ৩ হাজার ৩০৬ মার্কিন ডলার, যা ০.১৩ শতাংশ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে একাধিক বৈশ্বিক কারণ- বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, সুদের হারের নিম্নগতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্রমবর্ধমান স্বর্ণ মজুদের প্রবণতা।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও বাজারে অনিশ্চয়তা
সেঞ্চুরি ফিনান্সিয়ালের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা বিজয় ভালেচা বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনির্দেশ্য শুল্কনীতি এবং বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা বৈশ্বিক বাজারে ঝুঁকি বাড়িয়েছে, যার ফলে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের মতো নিরাপদ সম্পদের প্রতি ঝুঁকছেন।’
তিনি জানান, ট্রাম্প সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে উৎপাদিত আইফোনে ২৫ শতাংশ এবং ইউরোপীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দেন, যদিও তা আপাতত স্থগিত রয়েছে। ‘এমন অনিশ্চয়তা স্বর্ণের স্থায়ী চাহিদা তৈরি করছে।
তার পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শেষে স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে ৩ হাজার ৭০০ ডলার এবং ২০২৬ সালের মাঝামাঝি তা ৪ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে।
মজবুত অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট স্বর্ণের দামকে করছে স্থিতিশীল
ভালেচা আরও বলেন, ‘আমেরিকার ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২০০৭ সালের ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ১০০ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা, বাণিজ্য ঘাটতি এবং করছাড়ের মতো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এসব কারণেই স্বর্ণ আজ বিনিয়োগকারীদের কাছে নির্ভরযোগ্য নিরাপদ আশ্রয়।
ক্রেতাদের জন্য পরামর্শ: বিচক্ষণতা ও ধৈর্য জরুরি
টাইটান কোম্পানির আন্তর্জাতিক গহনা বিভাগের প্রধান আদিত্য সিংহ বলেন, ‘বর্তমান উচ্চমূল্য অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হলেও, এটি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে স্বর্ণের দাম সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী থাকে।’
তিনি খুচরা ক্রেতাদের পরামর্শ দেন, ‘আতঙ্কিত না হয়ে সুদের হার, মুদ্রাস্ফীতি, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ পরিস্থিতির দিকে নজর দিন। ছোট ছোট ধাপে নিয়মিত স্বর্ণ ক্রয় দীর্ঘমেয়াদে ভালো আর্থিক ফলাফল দিতে পারে।’
ঐতিহ্য ও আবেগের সঙ্গে স্বর্ণের বন্ধন অটুট
কল্যাণ জুয়েলার্সের নির্বাহী পরিচালক রমেশ কল্যাণারামন বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো সংস্কৃতিবান সমাজে স্বর্ণ কেবল একটি ধাতুই নয়, এটি আবেগ, ঐতিহ্য এবং আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এই চাহিদা প্রাকৃতিক মূল্য ওঠানামা সত্ত্বেও দীর্ঘমেয়াদে অব্যাহত থাকবে।’
বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিক পরিস্থিতি ও বাজার বিশ্লেষকদের মতামত বিবেচনায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রতি গ্রাম ৪০০ দিরহামের ওপরে স্বর্ণের দাম স্থিতিশীলভাবে বজায় থাকার সম্ভাবনা প্রবল। বিনিয়োগ, পারিবারিক অনুষ্ঠান কিংবা ভবিষ্যতের নিরাপদ সঞ্চয়ের মাধ্যম- যে উদ্দেশ্যেই হোক, স্বর্ণ আজও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনগণের আস্থা ও মূল্যবোধের প্রতিফলন।
এমআর