ইন্টার মিলানকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠানোর নায়ক ফ্রানসেস্কো আচেরবির জীবন হার মানায় রূপকথার গল্পকেও। শুধু ফুটবলের নয়, জীবনের পথ হারানো এক মানুষের আত্মত্যাগ, সহনশীলতা আর অবিচল মনোবলের গল্প। বাবার মৃত্যুর পর বিষণ্নতা ও মদ্যপানে আসক্ত হয়ে যাওয়া, দুইবার ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে আবারো ফুটবলে ফেরা, ক্যারিয়ারের শেষদিকে এসে ইন্টার মিলানের হয়ে ৩৭ বছর বয়সে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নায়ক হয়ে ওঠার মতো ঘটনা—সব মিলিয়ে এক অনন্য গল্প।
বার্সেলোনার বিপক্ষে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে ইন্টার মিলানের বিদায় যখন প্রায় নিশ্চিত তখনই ম্যাচের ৯৩তম মিনিটে গোল দিয়ে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন আচেরবি।
তার গোলে ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গড়ালে পরে ইন্টার জয়ী হয় ৭-৬ ব্যবধানে।ম্যাচ শেষে ইন্টার কোচ সিমোন ইনজাগি বলেছিলেন, ‘এই আক্রমণ ওর নিজের সিদ্ধান্ত ছিল। আমি কিছুই বলিনি।’
সতীর্থ খেলোয়াড় কার্লোস অগুস্তো বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে বক্সে ঢোকার শক্তি ও কোথা থেকে পেয়েছে, জানি না।কিন্তু আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই। মাঠের বাইরে ওর জীবনযুদ্ধের গল্পও অনন্য। আচেরবি কখনোই হাল ছাড়ে না।’মিলান শহর থেকে মাত্র ১৫ মাইল দূরে ভিজোলো প্রেদাবিস্সিতে জন্ম আচেরবির।পাভিয়ার হয়ে ২০০৬ সালে এখানেই তার ফুটবল-জীবনের সূচনা।
সিরি ডি-এর ক্লাব রেনাতে ধারে এক মৌসুম কাটানোর পর শুরু হয় তার ইতালি ভ্রমণ। যে পরিমাণে ক্লাব এই সময়ে তিনি পরিবর্তন করেছেন তাকে ভ্রমণ বললে খুব একটা ভুল হবে না।পাভিয়ার পর রেজিনা, জেনোয়া, চিয়েভো—এভাবেই একসময় তার উপর নজর পড়ে ঐতিহ্যবাহী ক্লাব এসি মিলানের।২০১২ সালে প্রিয় ক্লাবে যোগ দেন আচেরবি।
কিন্তু সেই স্বপ্ন দ্রুত ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। কারণ? বাবার মৃত্যু।এসি মিলানে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরই মারা যান আচেরবির বাবা। সে সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। শুরু করেন প্রচুর পরিমাণে অ্যালকোহল গ্রহণ।
আচেরবি বলেন, ‘আমি তখন প্রায়ই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অনুশীলনে যেতাম। শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলাম, তাই ভাবতাম সেটাই যথেষ্ট। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর আমার সবকিছু ভেঙে পড়ে। আমি খেলতেই পারতাম না।’
বাবাই ছিল এই ইতালিয়ানের সবচেয়ে বড় ভক্ত, আবার সবচেয়ে বড় সমালোচকও। সবসময় তার খেলার ভুল ধরিয়ে দিতেন।
এরপর মিলান থেকে ধারে চিয়েভো এবং পরে সাসসুওলোতে। কিন্তু ২০১৩ সালের জুলাইয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ধরা পড়ে টেস্টিকুলার ক্যানসার। অপারেশনের পর মাঠে ফিরলেও ডিসেম্বরে আবারও ধরা পড়ে ক্যানসার। শুরু হয় কেমোথেরাপির কঠিন লড়াই।
আচেরবি বলেন, ‘আশ্চর্যভাবে, এই রোগ আমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছে। আমি কে, আর কী চাই—তা বুঝতে পেরেছিলাম তখনই।’অসংখ্য কেমোথেরাপি শেষে ২০১৪-১৫ মৌসুমে আবার মাঠে নামেন। সাসসুওলোর হয়ে পাঁচটি সফল মৌসুম শেষে ২০১৮ সালে যোগ দেন লাজিওতে। সেখানেই কোচ ইনজাগির সঙ্গে তৈরি হয় দৃঢ় সম্পর্ক।
২০২২ সালে ইনজাগির আস্থাভাজন হিসেবেই ইন্টারে যোগ দেন এই যোদ্ধা। ক্লাবের অনেকে এবং সমর্থকদের একাংশ এতে খুশি ছিলেন না—তাদের আপত্তি ছিল তার অতীত ক্লাব এসি মিলান এ নিয়ে।
আচেরবির মনোবিদ ফ্রাংকিনি বলেন, ‘আমি ওকে বলেছিলাম ইন্টারে যেতে। ওর বাবা ছিলেন ইন্টার সমর্থক। এতে অন্তত বাবার কাছাকাছি যেতে পারবে ও।’
আচেরবির প্রিয় প্রাণী সিংহ। তার শরীরে প্রাণীটির একাধিক ট্যাটু—বুকে ‘দ্য লায়ন কিং’, পেটে গর্জনরত সিংহ, হাতে ‘মাদাগাস্কার’ সিনেমার সিংহ চরিত্র অ্যালেক্স।
ফিরে আসা সম্পর্কে আচেরবি বলেন, ‘আমার শিক্ষা—কখনো হাল ছেড়ো না। পড়া যাবে, কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই হবে। সঠিক মানসিকতা মানুষকে বদলে দিতে পারে। নিজেকে সাহায্য করতে হয়, বাইরে থেকে সমর্থন পেতে হলেও শুরুটা নিজের ভেতর থেকে করতে হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি জানি না, মিউনিখে জয় কি আমার জীবনের এক চক্রের সমাপ্তি হবে কিনা। তবে আমি এমন কেউ না যে একটা ফাইনাল হারলে থেমে যাবো।’
তিনি শুধু ক্যানসারের বিরুদ্ধে নয়, জাতীয় দলেও নিজের যোগ্যতা দেখিয়ে ফিরেছেন। প্রায় দুই বছর দলে না থাকলেও কোচ স্পালেত্তি অবশেষে তাকে ডেকেছেন নরওয়ে ও মলদোভার বিপক্ষে।
এমআর/টিএ