বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংস্কারে রোডম্যাপ ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ইউএনডিপি’র ‘রুল অব ল’ সম্মেলনে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের জন্য তার ঘোষিত রেডম্যাপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কার রোডম্যাপের মূল লক্ষ্য বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা এবং দক্ষ বিচার বিভাগ গড়ে তোলা।’

গতকাল মঙ্গলবার রাতে ইউএনডিপি’র বার্ষিক ‘রুল অব ল’ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে দেয়া বক্তৃতায় বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। নিউইয়র্কে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন (১০ থেকে ১২ জুন) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সম্মেলনে প্রধান বিচারপতি অনলাইনে যুক্ত হয়ে ভাষণ দেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিচার বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন।

প্রধান বিচারপতি বিশ্বব্যাপী আঞ্চলিকভাবে, জাতীয়ভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন , ইউএনডিপি’র ২৫তম বার্ষিক আইনের শাসন ও মানবাধিকার সভার উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ দিতে পেরে তিনি সম্মানিত বোধ করছি। বিশ্বব্যাপী আঞ্চলিকভাবে, জাতীয়ভাবে আইনের শাসন প্রচার, প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায্য ও সমান ন্যায়বিচার প্রদানকে সমর্থন করা, সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুবিধা নিশ্চিত করা এবং আইনের শাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের কাজ আগের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

তিনি বলেছেন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জাতিসংঘ সনদের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে নিহিত। যেখানে টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সংগত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা জোরদার করা, সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ প্রদান করা এবং সর্বস্তরে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি বলেছেন , শক্তিশালী এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ গড়ে তোলা এত কঠিন যে, এই ধারণার মুখোমুখি হয়ে আমি এই মিশনকে সমর্থন করার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানাচ্ছি।

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন , পরিবর্তনশীল দেশগুলোতে আইনের শাসন সংস্কারের কেন্দ্রীয়তা এবং জাতিসংঘের বিশেষ করে ইউএনডিপি’র সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম ন্যায়বিচারকে কার্যকরভাবে সমর্থন করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ব্যাপক ও বিশেষায়িত দক্ষতা এবং রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের জন্য আরো প্রয়োজনীয় সহায়তা বৃদ্ধির আহ্বান জানান প্রধান বিচারপতি।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সংস্কার রোডম্যাপের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার পতনের পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাত্রা শুরু করে।

তিনি বলেছেন, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবে অন্যায়, স্বেচ্ছাচারিতা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণদের এক অভূতপূর্ব বিদ্রোহ এবং ন্যায়বিচারের এক স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিপ্লবের চূড়ান্ত মূল্য পরিশোধের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিচারিক সংস্কারের জন্য একটি রূপান্তরমূলক এজেন্ডার মাধ্যমে ন্যায়বিচার পুনরুদ্ধারে আমার সংকল্পকে আরো দৃঢ় করেছে।

প্রধান বিচারপতি বলেছেন , উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ৪২ লাখের বেশি মামলার জট এবং বিচার বিভাগের প্রতি গভীরভাবে প্রোথিত অবিশ্বাস, ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিকরণের কারণে ক্ষয়ে যাওয়া বিচার বিভাগ সংস্কারে আমাকে নিরুৎসাহিত করেনি। বরং, যারা রাস্তায় নেমেছিল ন্যায়বিচারের জন্য, বাংলাদেশের জনগণের চাহিদা এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে আমি ‘সংস্কার রোডম্যাপ’ ঘোষণা করি।

সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন , আমাদের সংস্কার রোডম্যাপের মূল লক্ষ্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং দক্ষ বিচার বিভাগ গড়ে তোলা। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক মান ও নিয়মাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সততা, ডিজিটাল রূপান্তর, জনকেন্দ্রিক পদ্ধতি এবং প্রচারণা সংক্রান্ত পরামর্শসহ প্রযুক্তিগত দক্ষতার মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নে ইউএনডিপি আমাদের সহায়তা করে আসছে।

তিনি বলেছেন, ইউএনডিপি দ্বারা সমর্থিত ট্রানজিশনাল ন্যায়বিচার সরঞ্জামগুলোর ওপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক মতবিনিময় আমার এই দৃঢ় বিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করেছে যে, বিচার বিভাগের সুদূরপ্রসারী এবং রূপান্তরকারী সংস্কারগুলো অন্যায্য এবং স্বৈরাচারী শাসন থেকে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ গণতন্ত্রে যেকোনো রূপান্তরের ক্ষেত্রে সংস্কারের ভিত্তি হওয়া উচিত।

প্রধান বিচারপতি বলেছেন , সাংবিধানিকতা বৈধতা এবং মানবাধিকারের অভিভাবক হিসেবে অন্যান্য সব সংস্কার প্রচেষ্টার সম্মতি প্রদানকারী বিচার বিভাগকে অবশ্যই প্রথমে স্বৈরাচারী কব্জা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে এবং আমাদের আদালতের সামনে ন্যায়বিচার প্রার্থীদের জন্য কার্যকর প্রতিকার প্রদানকারী একটি স্বাধীন এবং বিশ্বস্ত বিচারক হিসেবে নিজেকে রূপান্তরিত করতে হবে।

ড. রেফাত বলেছেন , বাংলাদেশকে উন্নত ভবিষ্যতের দিকে উত্তরণের উদাহরণ হিসেবে যতটা সম্ভব চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতেও ন্যায়বিচার সংস্কারের আমাদের দৃঢ় প্রচেষ্টা সব বাংলাদেশি পুরুষ ও নারীর জন্য আশার স্তম্ভ হয়ে থাকবে। এটা মনে রাখতে হবে, যখন ন্যায়বিচার অনুপস্থিত থাকে তখন তা রাস্তায় প্রতিফলিত হবে। ন্যায়বিচার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আমাদের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং মানবাধিকারে দুঢ় অবস্থানে পৌঁছে দিবে।

কেএন/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
রাজশাহীতে বিয়েবাড়িতে যাওয়ার পথে ট্রাকের ধাক্কায় নিহত ১, আহত ৭ Jun 14, 2025
‘সরকার মানেই শত্রু!’—গার্ডিয়ানের সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস Jun 14, 2025
আগে মেম্বার ইলেকশনে জিতে দেখাও : হাসনাতকে নাসিরুদ্দীনের স্যাটায়ার Jun 14, 2025
img
১৩ মামলার আসামি মজনু গ্রেফতার Jun 14, 2025
img
এবার হামলার দৃশ্য ‘বিশ্ববাসীকে সরাসরি দেখার’ আমন্ত্রণ জানাল ইরান! Jun 14, 2025
img
ইরানে হামলা নিয়ে ট্রাম্প বললেন, আমরা আগে থেকেই সব জানতাম Jun 14, 2025
img
একটি দলের প্রতি প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন: জামায়াত Jun 14, 2025
img
উপদেষ্টা পরিষদ টিম বনাম কূটনৈতিক টিম, বার্তা আসিফ মাহমুদের Jun 14, 2025
img
বড় ভাই সাকিবের কাছ থেকে যে পরামর্শ পেলেন অধিনায়ক মিরাজ Jun 14, 2025
রুমে ডেকে নিয়ে স্যার আমাকে প্রভা আপুর ভিডিও দেখিয়েছে: মিস্টি জান্নাত Jun 14, 2025
ঠোঁট নিয়ে কটাক্ষের জবাব দিলেন বর্ষা Jun 14, 2025
img
তারা নিজেদের সঙ্গে বিএনপিকে নিয়ে না ডুবলেই হয় : এনসিপি নেতা তুষার Jun 14, 2025
img
অবশেষে চোকার থেকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকা Jun 14, 2025
img
ড. ইউনূসের বিস্ময়কর বিজয় ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে : রনি Jun 14, 2025
img
দেশে কোনো নেতা নেই, নেতৃত্ব নেই, মরে গেলেও কেউ দেখবে না : ফজলুর রহমান Jun 14, 2025
img
চট্টগ্রামে গ্রেফতার হলেন চাকরির নামে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো চক্রের মূল হোতা Jun 14, 2025
img
ব্যক্তিগত স্পন্সরে বেঁচে আছে ফুটবল, ক্লাবগুলোর অবদানে কৃতজ্ঞ বাফুফে Jun 14, 2025
img
চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত আরও একজন Jun 14, 2025
img
নেতানিয়াহুর আয়রন ডোম চুরমার করে দিল ইরান Jun 14, 2025
img
শ্রীলঙ্কা সিরিজে ফেরা হবে তাসকিনের? Jun 14, 2025