ট্রাম্প ‘বলেন এক কথা, করেন আরেক কথা’

ন ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত শুরুর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরান সম্পর্কে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, সেগুলোকে পরস্পর বিরোধী বলে মনে হচ্ছে।

সম্প্রতি তিনি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে শিগগিরই শান্তি আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এরপরই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইসরাইলে সঙ্গে যুদ্ধে যোগদানের পাশাপাশি একটি সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে।

সবশেষ বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ইরানে হামলায় ইসরাইলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেবে কিনা ট্রাম্প দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন।

ট্রাম্পের এই অবস্থানের পরিবর্তনকে কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, ইরান নিয়ে তার (ট্রাম্পের) হয়তো কোনো স্পষ্ট কৌশল বা শেষ লক্ষ্য নেই। অন্যদিকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চান যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে অংশ যোগ দিক।

ট্রাম্প কি ইরানের বিরুদ্ধে তার ক্রমবর্ধমান যুদ্ধবাজ বক্তব্য ব্যবহার করে তেহরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করতে রাজি হতে বাধ্য করছেন?

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তেহরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের ক্রমবর্ধমান যুদ্ধবাজ বক্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।

ন্যাশনাল ইরানিয়ান আমেরিকান কাউন্সিলের সভাপতি জামাল আবদি বলেন, ট্রাম্প ইরানকে ‘সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ’ এর দাবি মেনে নিতে বাধ্য করার হুমকি দিয়ে তার ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারেন।

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এসবের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন পাগল হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন। তিনি অপ্রত্যাশিত এবং এই কঠোর নীতির ওপর জোর দিয়ে ইরানের কয়েক দশক ধরে সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছেন। যা তেহরান বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।


আবদি আরও বলেন, ‘ট্রাম্পের সবশেষ বক্তব্যের আরেকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো নেতানিয়াহু তাকে ইরানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য করার জন্য প্ররোচিত করছেন।’

ট্রাম্প বলেন এক কথা, করেন আরেক কথা

ইরানি-আমেরিকান বিশ্লেষক নেগার মোর্তাজাভি বলেন, নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে ‘কৌশলগতভাবে পরাজিত’ করছেন। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, আমি জানি না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানেন কিনা তিনি আসলে কী চান।
নেগার মোর্তাজাভি বলেন, ‘তিনি শান্তির প্রেসিডেন্ট হবেন এ বার্তা দিয়ে ভোটের আগে প্রচারণা চালিয়েছিলেন ... তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে সংঘাতের অবসান ঘটাবেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। গাজায়

যুদ্ধ আরও তীব্র হয়েছে এবং এখন তিনি ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের তত্ত্বাবধান করেছেন। ফলে, বলাই যায় ট্রাম্প বলেন এক কথা, করেন আরেক কথা।’

ওমানের মাস্কাটে মার্কিন ও ইরানি কর্মকর্তাদের ষষ্ঠ দফা আলোচনায় মিলিত হওয়ার দুই দিন আগে গত সপ্তাহে (১৩ জুন) ইসরাইল ইরানে আকস্মিক হামলা শুরু করে।

ইসরাইলি হামলা শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে, ট্রাম্প কূটনীতিতে সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ইসরাইলের হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল ওয়াশিংটন এই হামলায় জড়িত নয়।

তবে পরবর্তী দিনগুলোতে ট্রাম্পকে ইসরাইলি বোমা হামলার জন্য কৃতিত্ব নিতে দেখা গেছে। মঙ্গলবার সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘ইরানের আকাশ এখন আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। ইরানের কাছে ভালো আকাশ ট্র্যাকার এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম ছিল কিন্তু আমেরিকান তৈরি জিনিসপত্রের সঙ্গে এর তুলনাই হয় না।

ইসরাইলের হামলায় ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা, সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা, জ্বালানি অবকাঠামো এবং আবাসিক ভবন লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। যার ফলে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে শীর্ষ সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকর্তা এবং অনেক বেসামরিক নাগরিকও রয়েছে। বিপরীতে ইরান শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এতে কমপক্ষে ২৪ জন ইসরাইলি নিহত হয়েছে এবং দেশজুড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে।

ইসরাইলি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তারা ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে যে, তাদের সামরিক অভিযান ইরানের শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটাতে পারে, যা ইসরাইলের অন্যতম লক্ষ্যও বটে।

তবে, এটি ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, ভূগর্ভস্থ অবস্থিত ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ (ফোরদো) স্থাপনা ধ্বংস করতে ইসরাইলের মার্কিন সাহায্যের প্রয়োজন হবে।
মোর্তাজাভি বলেন, যুদ্ধবাজ এবং ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ট্রাম্পের কাছে যুক্তি দিচ্ছেন যে ফোরদোতে বোমা হামলা করা একটি সহজ কাজ হবে।

এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জড়ালে ইরান যেকোনো মার্কিন ঘাঁটিতে আক্রমণের কঠোর প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এই অঞ্চলে থাকা হাজার হাজার মার্কিন সেনা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হতে পারে। যুদ্ধ আরও তীব্র হলে, ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে।


ইরানের আইন প্রণেতারা এরইমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। এই পথ দিয়ে বিশ্বের ২০ শতাংশ তেল প্রবাহিত হয়।
‘বিপর্যয়কর’ যুদ্ধ

মোর্তাজাভি বলেন, সংঘাত বৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলের জন্য ‘বিপর্যয়কর’ পরিণতি হবে। এমনকি ইরান হয়ে যেতে পারে ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো।

ইরাকে বুশের শাসনামলের যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে সাম্প্রদায়িক রক্তপাত এবং আইএসআইএল (আইএসআইএস) এর মতো গোষ্ঠীর উত্থানের দিকে পরিচালিত করেছে। আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী রাজধানী কাবুল থেকে

তালেবানদের উৎখাত করার পর ২০ বছর ধরে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীটি দ্রুত ক্ষমতায় ফিরে আসে।

মার্কিন ও ইসরাইলি আঘাতে ইরানের শাসন ব্যবস্থার পতন হলেও, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মার্কিন যুদ্ধবাজদের নিজেদের ইচ্ছা সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান ৯ কোটিরও বেশি মানুষের একটি দেশ। সরকারের পতন অভ্যন্তরীণ সংঘাত, বাস্তুচ্যুতি সংকট এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

মোর্তাজাভি বলেন, ‘এটি কোনো রঙিন বিপ্লব নয়। এটি যুদ্ধ এবং বিশৃঙ্খলা, সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এবং অস্থিরতা হতে পারে।’ অধিকার গোষ্ঠী ডিএডব্লিউএন-এর নির্বাহী পরিচালক সারাহ লিয়া হুইটসন বলেন, ট্রাম্প যদি হুমকি দিয়ে ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করেন এবং ইরানে যুদ্ধ বা শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন নাও চান, তবুও এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ইরানের ওপর আক্রমণ শুধুমাত্র একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে নয়, বরং সম্ভাব্যভাবে একটি বিশ্বব্যাপী যুদ্ধে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অব্যাহত যুদ্ধবাজ মনোভাব এবং শত্রুতাপূর্ণ বক্তব্য আগুনে ঘি ঢালছে।


পিএ/টিএ 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
চতুর্থ দিনের খেলা শেষে গল টেস্ট এখনো বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে Jun 20, 2025
img
ইরানের আরেক পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত, দাবি ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমের Jun 20, 2025
img
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য গবেষণা অনুদান দেবে ইউজিসি Jun 20, 2025
আমিরাত ভিসা নিয়ে ইরান হটলাইনে প্রবাসীদের ফোন Jun 20, 2025
img
‘বাংলাদেশের সঙ্গে সবক্ষেত্রে আন্তঃসম্পর্ক জোরদারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভারত’ Jun 20, 2025
img
‘সিতারে জমিন পার’ নিয়ে আশাবাদী আমির, সিনেমার বিশেষ স্ক্রিনিংয়ে হাজির শাহরুখ Jun 20, 2025
img
পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশি যুবকের মরদেহ হস্তান্তর Jun 20, 2025
ফিফা টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের মালিক এখন মেসি! Jun 20, 2025
img
‘কেশরী চ্যাপ্টার ২’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন সৃজিত-ঋত্বিক! Jun 20, 2025
ঐশ্বরিয়া-অভিষেক জুটি নিয়ে নতুন গুঞ্জন Jun 20, 2025
ভাইরাল ভিডিওতে বিপাকে শরীয়তপুরের ডিসি! Jun 20, 2025
স্বাস্থ্য বিভাগের চাকরি দিচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী নেতা, লাগবে ১০ লাখ টাকা Jun 20, 2025
আশুলিয়ায় ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধার, গ্রেফতার-২ Jun 20, 2025
img
পুলিশের বিশেষ অভিযানে ঢাকাসহ সারা দেশে গ্রেফতার ১৭৮২ জন Jun 20, 2025
img
অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ সারজিস আলমের Jun 20, 2025
img
কপিলের শোয়ে সালমানকে নকল করে হইচই ফেললেন সুনীল Jun 20, 2025
img
আক্রমণ অব্যাহত থাকলে জবাব আরও তীব্র হবে : দাবি ইরানের প্রেসিডেন্টের Jun 20, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পারমাণবিক পরিকল্পনায় বিপর্যয়ের ইঙ্গিত রাশিয়ার Jun 20, 2025
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্বের মর্যাদাবান মানুষদের আনন্দিত করেছে: খামেনি Jun 20, 2025
আশুলিয়ায় ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধার, গ্রেফতার- Jun 20, 2025