আমাদের কোনও শাখা নেই- এমন বিজ্ঞাপন আমরা দেখেছি কিংবা ধরুন ‘এ স্বাদের ভাগ হয় না’ এমন ক্যাচলাইন আমাদের কাছে বহু পরিচিত। তার মানে বলা হচ্ছে আসল নকল চিনতে শিখুন, অরিজিনালই হল আসল। ঠিক তেমন ক্লাসিক সিনেমার রিমেক হয় না, সিক্যুয়েলও অরিজিনালকে টপকাতে পারে না। পঞ্চায়েত সিজন ফোর দেখতে দেখতে এটাই মনে হচ্ছিল। গ্রাম্য জীবনের যে সারল্য, হাস্যরস, ছোট দুঃখ, ছোট-ছোট ব্যথা, মুচকি হাসি, চোখের দুই ফোঁটা জল আর শহুরে চালাকির থেকে দূরের একটা দৈনন্দিন রোজনামচা দিয়ে এই ওয়েব সিরিজ শুরু হয়েছিল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে অনেকটাই সরে গিয়েছে। দ্বিতীয় সিজনের শেষ থেকেই সেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল। ফুলেরার মানুষজনকে ঠিক যে কারণে ভালো লেগেছিল, ঠিক সেটাই কেড়ে নেওয়া হল তাদের থেকে।
সিজন ফোর-এর কেন্দ্রে রয়েছে পঞ্চায়েত ইলেকশন। একদিকে মঞ্জু দেবী অন্যদিকে ক্রান্তি দেবী। আসল লড়াই তাদের বিবাহিত পুরুষ সঙ্গী প্রধানজী এবং ভূষণের মধ্যে । আর এই ইলেকশনকে ঘিরে নানা কাণ্ড। ভোট প্রচারের লড়াই, হাতাহাতি, রাজনীতির নানান কূটকাচালি, ক্ষমতা নিয়ে খ্যাপামি! এই সিরিজ যত এগিয়েছে প্রধানজীর চরিত্র তত বেশি বিরক্তির উদ্রেক করেছে। প্রথম সিজনের পর কোথায় ভেবেছিলাম সাইডলাইন হয়ে যাওয়া আসল প্রধান অর্থাৎ মঞ্জু দেবী তার অস্তিত্ব খুঁজে নেবেন, তা আর হল কই! ভেবেছিলাম শহুরে যুবকের সঙ্গে গ্রামের মেয়ে রিঙ্কির প্রেমটা যেটা হতে পারত একটা অমসৃণ, সূক্ষ তারে বাঁধা এক লয়কারী, প্রাইড এন্ড প্রেজুডিসের মতো ‘পথে হলো দেরি’ প্রেম। সেই প্লটকে ভীষণ খাপছাড়া ভাবে ব্যবহার করা হল। তাতে মাধুর্য এবং গুরুত্ব দুইই হারাল। প্রহ্লাদচা এবং বিকাশের চরিত্রের নির্যাসও যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। সিরিজের হিরো,সচিবজী, তাঁকে এই ইলেকশনের ডামাডোলের বাজারে একটু দিশেহারা লাগল। তাবলে একটু হাসি- মশকরা কী নেই, তা আছে। কিন্তু যে অমলিন ‘হৃদয়’ ছিল ‘পঞ্চায়েত’-এর প্রধান, তার বদলে জাঁকিয়ে বসেছে সন্দেহ, বিরক্তি, হিংসা। এসব জীবনেরই অঙ্গ কিন্তু সেটা এই ওয়েব সিরিজের গোড়ার দিকের ফুলেরার যে জীবনশৈলী তার সঙ্গে মিশে যায়নি । এই নতুন সিরিজে ফুলেরার চারিত্রিক মিউটেশন ঘটেছে যেন। গোটা ভারতের প্রেক্ষিতে বড় ক্যানভাস, প্যান ইন্ডিয়ান এলিমেন্ট রাখতে গিয়ে ফুলেরার ছোট্ট প্রাণ যেন হাঁসফাঁস করেছে।
তবে এই সিরিজে বিনোদ (অশোক পাঠক) একমাত্র চরিত্র যে সেই পুরনো ফুলেরাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রধানজি এবং তার দলবল এই বোকা অথচ বদমাইশিতে কম না যাওয়া বিনোদকে নেমন্তন্ন করে, যদি সে দল বদলায় এবং প্রতিপক্ষের দূর্বলতা প্রকাশ করে দেয়। ভরপেট লুচি, সিমুইয়ের পায়েস খাওয়ার পর বিনোদ বুঝতে পারে তাঁকে ভালবেসে নয় স্বার্থ আছে বলেই এই আপ্যায়ন। ভালো করে দুইবেলা খেতে পায় না তাই তো সে রাজি হলো নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। বুঝতে পেরে ভারী মনখারাপ হল তার। এই মনখারাপ খুব চেনা। একেক সময় তুমি খুব উৎসাহ নিয়ে মানুষের সঙ্গে মিশলে, তুমি ভাবলে তোমাকে তোমার কারণেই তারা ভালবেসে আপন করে নিয়েছে।
তাদের মান্যতা পেয়ে তুমি আপ্লুত। তারপর বুঝলে না, তোমার অস্তিত্ব আসলে কোনওদিনই ম্যাটার করেনি। এটা বুঝতে পারলে যে ঠকে যাওয়ার কষ্ট হয়, বিনোদেরও তাই হয়েছিল। তাই কোনওমতে সে বলে, ‘ম্যায় গরিব হো সকতা হু পর গদ্দার নেহি!’ এমন সত্যি অনুভবের জায়গা এই সিরিজে কম আছে।
আর একটা দৃশ্যও মনে থাকবে। মঞ্জু দেবীর দল হেরে যাওয়ার পর ভূষণের বিজয় মিছিল থেকে বেরিয়ে সেই বিনোদ পরাজিত দলের কাছে নাচতে নাচতে মিষ্টি নিয়ে এল। সেই এগিয়ে আসার মধ্যে ছিল না বিজয়ীর আস্ফালন। ছিল সাচ্চা খেলোয়াড়ি মনোভাব। তোমরা হেরে গেছো তো কি হয়েছে আমাদের আনন্দ তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। মঞ্জু দেবী ছাড়া ওই মিষ্টি আর কেউ স্পর্শ করেনি সে অন্য কথা। বিনোদ আবার হাসি মুখে নাচতে নাচতেই ফিরে গেল। এই জয়ের ভাগে তাঁর ভাঁড়ার শূন্য সে অনেক আগেই জানে। তার পাওয়ারও কিছু নেই হারানোরও কিছু নেই। ভূষণ তাঁকে কিস্যু দেবে না। কিন্তু তবু বিনোদের আনন্দে কোনও ভেজাল ছিল না। সে কেবল জানে সে যার পাশে থেকেছে সেই লোকটা জিতেছে। বিনোদ নিজের বন্ধুত্বের ধর্ম পালন করতে পেরেই খুশি। এইটুকুই তার পাওয়া। আর পঞ্চায়েত সিজন ফোর থেকে এইটুকুই পাওনা আমারও।
এফপি/এসএন