এনসিপির দলীয় চেতনা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন নীলা ইসরাফিল

অনৈতিক প্রস্তাবের অভিযোগে এবার অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন এনসিপি সদস্য নীলা ইসরাফিল। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তদন্ত কমিটি বরাবর দাখিলকৃত অভিযোগপত্রের একটি কপি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ওই কপিতে তিনি উল্লেখ করেছেন তিনি এনসিপি নেতা তুষারের দ্বারা কিভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

নীলা এতে লেখেন, আমি, নীলা ইসরাফিল, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একজন নিবেদিতপ্রাণ, আদর্শনিষ্ঠ এবং মেধাবী কর্মী হিসেবে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য হিসাবে শুরু করে, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক দলের নীতিগত লড়াই, আন্দোলন ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছি।

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আমার কাছে কোনো লোভ বা পদ-পদবির বিষয় নয়; এটি আমার নৈতিক ও আদর্শিক বেছে নেওয়া পথ, একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন।

আমার উত্থাপিত অভিযোগ আমি অত্যন্ত সাহস এবং একইসাথে দুঃখ, এবং মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে করছি, শুধুমাত্র নিজের সম্মানরক্ষার জন্য নয়, বরং সংগঠনের নারী সদস্যদের জন্য একটি নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিসর প্রতিষ্ঠার আশায়।

নীলা নিজের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আমি এক নির্মম সহিংসতার শিকার হই, আমার প্রাক্তন স্বামী মোয়াজ আরিফ ঢাকা ক্লাবে আমাকে হত্যার চেষ্টা করে, যদিও নিপীড়ণ-নির্যাতন এবং যৌন হয়রানি বিবাহ বিচ্ছেদের পরে কয়েক বছর ধরে চলছিল। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য অপব্যবহার করে আমাকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়।

এই ঘটনায় আমি শারীরিক, মানসিক এবং সাংগঠনিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হই। শারীরিক ও মানসিক, সুরক্ষার স্বার্থে আমাকে বাংলাদেশ ত্যাগ করে নেপালে যেতে হয়।

সারোয়ার তুষারের সঙ্গে এ সময়েই যোগাযোগ হয় জানিয়ে নীলা বলেন, এই সময়টিতে সারোয়ার তুষার ছিলেন অনেকের মতো আমার সঙ্গে যোগাযোগে থাকা রাজনৈতিক সহকর্মী, যিনি পূর্বেও আহত অবস্থায় অনেকের মত মানবিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন। সেই আস্থার জায়গা থেকেই আমি তার সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ চালিয়ে যাই।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্ককে তিনি ব্যক্তিগত ও অনৈতিক রূপ, যৌন হয়রানি করতে উদ্যত হন।

নীলা ৪ টি ধাপে সুনির্দিষ্ট অনৈতিক আচরণসমূহ উল্লেখ করেছেন। এসব হলো-
১. নৈশকালীন ব্যক্তিগত ও আপত্তিকর আলাপ:
তিনি প্রায়ই রাতের বেলা কল করে বলেন, “রাজনীতি নিয়ে কথা ভালো লাগে না, তোমার কণ্ঠে ভালো লাগে প্রতিবাদের স্লোগান,” “তোমার ঠোঁট সুন্দর,” “একটা সুন্দর ছবি পাঠাও” এই ধরনের মন্তব্য বারবার আমাকে অস্বস্তি ও অপমানের মধ্যে ফেলেছে।

২. ভিডিও কলে কথা বলার চাপ ও ব্যক্তিগত ছবি চাওয়া:
আমি বারংবার অনুরোধ করেছি পেশাদার সীমা রক্ষা করতে। এরপরও তিনি বারবার ব্যক্তিগত আলাপের দিকে আলোকপাত করেন।
ছবি চাইতেন এবং ভিডিও কলে কথা বলতে চাইতেন।

৩. ডিবি অফিসারের কাছে আমার সম্পর্কে মিথ্যা দাবি:
তিনি বলেন, “তোমার বিষয়ে ডিবি অফিসার আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বলেছি, তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড।” একজন রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে এ ধরনের ভ্রান্ত তথ্য প্রদান চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং আমার সামাজিক মর্যাদাকে হেয় করার শামিল।

৪. ফোনালাপ রেকর্ড ও প্রচারের ঘটনা:
আমি যখন বুঝতে পারি, এই রাজনৈতিক সম্পর্ক আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ও মানসিকভাবে নিঃশেষ করছে, তখন ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে তুষারের সঙ্গে কয়েকটি ফোনালাপ রেকর্ড করি। ১৬ জুন সেই রেকর্ডের একটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তুষার আমাকে চাপ দিতে থাকেন যেন আমি ফেসবুকে বলি, “তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।” আমি তখন দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফোনালাপও রেকর্ড করি এবং এগুলো কিছু মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকের মাধ্যমে প্রচারে সম্মতি দিই। কেননা, সেইগুলো উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানিমূলক, এবং যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ করে তা প্রকাশ করা থেকে বিরত করবার চেষ্টাও হয়েছিল অবিরত।


দলীয় পদক্ষেপ না থাকায় নীলা নিজের হতাশার কথা উল্লেখ করেছেন। অভিযোগপত্রে নীলা বলেন, ৭ জুন ২০২৫, ঈদের রাতে আমি বিষয়টি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জানাই এবং তুষারের দেয়া আপত্তিকর ম্যাসেজগুলো দেখাই। ওনার পরামর্শে ১৫ জুন (ঈদের ছুটির কারণে সব বন্ধ থাকায়) আমি মহানগর প্রতিনিধিদের শাহরিয়ার ও নিজামকে বিষয়টি জানাই। এখানে বলে রাখা ভাল, দুইজন পুরুষ সহকর্মী নিকট এই বিষয়ে আলাপ করতে অস্বস্তি বোধ করি, যার ফলে পরে আমি জ্যেষ্ঠ আহ্ববায়ক সামান্তা শারমীনকেও বিষয়টি জানাই।

১৬ জুন রেকর্ডটি সোশ্যাল মিডিয়ার ছড়িয়ে পড়লে আমি আবার এনসিপির প্রধান কার্য্যালয়ে যাই বিষয়টি নিয়ে কথা বলে সাংগঠনিকভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য। কিন্তু কারো কাছ থেকে তেমন কোনও সাড়া না পেয়ে রাতে বাসায় ফিরে আসি। আমার এই কঠিন সময়ে দলের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো লিখিত বিবৃতি, সহানুভূতি বা সুরক্ষা প্রদান করা হয়নি। ১৯ জুন এনসিপির পক্ষ থেকে আমাকে লিখিত অভিযোগ জমা দিতে বলা হয়। এছাড়া সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্বশীল বা আন্তরিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি; এই ধরনের নিরবতা, গা-ছাড়া আচরণ, এবং একটি নারীর সম্মান নিয়ে কৌশলগত নিস্পৃহতা একটি প্রগতিশীল দলের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

একইসাথে, আমি বলতে চাই, রাজনীতিতে একজন নারী হিসেবে পথ চলাটা সহজ নয়, শিল্পী হিসাবেও বুঝেছি অনেক আগেই । কিন্তু সত্য বলার পর, দলের ভেতরে যে ভয়াবহ মানসিক নিপীড়নের মুখে পড়তে হবে, সেটা কল্পনাও করিনি। আপনারা মনে করতে পারেন, আমার লিখা এবং তুষারের সাথে রেকর্ডিং ছড়িয়ে মব করতে চেয়েছি, ভুল আপনারা, আমার লিখা এবং তুষারের সাথে রেকর্ডিং তুষারের অপরাধের প্রমাণ।

আপনারা জেনে অবাক হবেন, তুষারের বিপক্ষে অভিযোগ জানানোর পরে; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুক, WhatsApp এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে গ্রুপে শুরু হয়ে গেল উশৃঙ্খল জনতার বিশৃঙ্খলা (মব ট্রায়াল) দলবদ্ধভাবে নিন্দা, অপপ্রচার, চরিত্রহননের চেষ্টা। এই কোনো আইনি প্রক্রিয়া নয়। এটা এক ধরণের ডিজিটাল লিঞ্চিং।

এনসিপির দলীয় চেতনা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নীলা বলেন, আপনাদের জেনে রাখা ভালো, কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে "মত তৈরি" করছেন, গুজব ছড়াচ্ছেন, এবং আমার সম্মান এবং আত্মমর্যাদাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আপনারা এই বিষয়ে অবগত নন? কোন ব্যবস্থা কি নিয়েছেন? কোন কর্মী যদি এই ভুক্তভোগীকে অপরাধিকরণ করে কোন নীতিমালা আছে? এটাই কি আপনাদের দলীয় চেতনা এবং নৈতিকতা, যার কথা বলে আমরা জনগণের সামনে দাঁড়াই?
নিজের তিনটি দাবি এই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন এই নারী নেত্রী।

১. একটি নিরপেক্ষ, নারীবান্ধব এবং স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে সারোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে যথাযথ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

২. নারী কর্মীদের জন্য স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর অভ্যন্তরীণ অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা (Internal Complaint Redressal Mechanism) অবিলম্বে চালু করা হোক।

৩. এনসিপি এই ঘটনায় দায় এড়িয়ে নয়, বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান নিক, যা দলকে আরও বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নীতিনিষ্ঠ করে তুলবে।

আমি এই অভিযোগ করেছি দীর্ঘ আত্মসংযমের পর, অনেক চিন্তা ও মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। আমি দলীয়ভাবে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি এবং বিশ্বাস করি, সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে এনসিপি একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, যেখানে নারী কর্মী কেবল ভুক্তভোগী নয়, বরং সম্মানিত ও নিরাপদ রাজনৈতিক অংশীদার।

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

ইসলাম কি আসলেই কঠিন Jun 26, 2025
img
স্বাধীন ইসি থাকলে স্বৈরাচারের উৎপত্তি বন্ধ হবে : সালাহউদ্দিন Jun 26, 2025
img
বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় জোট নয়: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা Jun 26, 2025
img
ট্রাম্পের সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানালেন নেতানিয়াহু Jun 26, 2025
img
ডিএমপিতে রদবদল হলো ঊর্ধ্বতন ৬ কর্মকর্তার Jun 26, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন সিইসি Jun 26, 2025
img
আল্লু অর্জুন ছাড়াই শুরু হচ্ছে বহুল আলোচিত আইকনের শুটিং Jun 26, 2025
img
১ জুলাই থেকে কত টাকা বেতন বাড়বে কার Jun 26, 2025
img
যুদ্ধ বিরতির পর প্রথম ভাষণে যা বললেন আয়াতুল্লাহ খামেনি Jun 26, 2025
img
৫০ বছর পর নতুন রূপে ফিরছে ‘শোলে’, দেখানো হবে কেটে বাদ দেওয়া দৃশ্য Jun 26, 2025
img
ইসরায়েল ধ্বংসের মুখে ছিল বলেই হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র দাবি খামেনির Jun 26, 2025
img
নিজের নামে ভুয়া আইডি নিয়ে মুখ খুললেন কুসুম শিকদার Jun 26, 2025
img
মায়ামিতে ২১ দলের খেলোয়াড়দের বেতনকে পেছনে ফেলেছেন মেসি একাই! Jun 26, 2025
img
বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালো ইরান Jun 26, 2025
img
আ. লীগ সরকারের আমলে নামকরণ করা ৯৭৭ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন শেষের দিকে Jun 26, 2025
img
আমেরিকার মুখে এক কঠিন থাপ্পড় মেরেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান: খামেনি Jun 26, 2025
img
‘নতুন বাংলাদেশের জন্ম ৮ নয়, ৫ আগস্ট’ Jun 26, 2025
img
৬ বছরের দাম্পত্যের ইতি, কনার বিচ্ছেদের পর ছড়িয়েছে পরকীয়ার গুঞ্জন Jun 26, 2025
img
অতিরিক্ত খোলামেলা দৃশ্য, ভারতে মুক্তি পায়নি যেসব সিনেমা Jun 26, 2025
img
সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রধান উপদেষ্টার জরুরি নির্দেশনা Jun 26, 2025