‘লাইফ ইন আ মেট্রো’র ১৮ বছর পর এল সিক্যুয়েল ‘মেট্রো ইন দিনো’। সময়ের ব্যবধান নেহাত কম নয়। আমাদের চারপাশ বদলে গিয়েছে অনেকটাই। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এই সিক্যুয়েল খানিক সেফ, আবার একটু আনসেফ-ও। মোদ্দা বিষয়গুলো মোটামুটি এই- পরকীয়া, ফেলে আসা প্রেম, মিড লাইফ ক্রাইসিস, অফিস হ্যারাসমেন্ট, ভ্রুণহত্যা, শিথিল দাম্পত্য, কেরিয়ার ক্রাইসিস এবং হ্যাঁ, কুইয়ার প্রেজেন্স। আজকাল যে কোনও ওয়েব সিরিজ বা ছবিতে এলজিবিটিকিউ দৃশ্যমান।
এটা যেমন ভালো আবার সেনসিটিভলি বিষয়টা উপস্থাপন না করলে সমস্যারও। তবে হ্যাঁ, এটা মেনে নিতেই হবে যে ভিজিবিলিটি বেড়েছে নিঃসন্দেহে। গল্পের পাত্র-পাত্রীরা হলেন মন্টি-কাজল (পঙ্কজ ত্রিপাঠি, কঙ্কনা সেন শর্মা) , চুমকি-পার্থ (সারা আলি খান, আদিত্য রায় কাপুর), আকাশ-শ্রুতি (আলি ফজল, ফাতিমা সানা শেখ) এবং শিবানী-পরিমল (নীনা গুপ্তা, অনুপম খের)। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, দর্শনা বণিক। স্বল্প পরিসরে ভালো লাগে তাদের এবং কাজলের মেয়ের ভূমিকায় নবাগতা অভিনেত্রী।
১৮ বছর আগের ছবিটা সম্প্রতি দেখা না থাকলেও, সেই ছবির গান আর টুকরো মুহূর্ত বেশ মনে আছে। ইরফান-কঙ্কনার ম্যাজিক জুটি, শাইনি আহুজা-শিল্পা শেট্টির অব্যক্ত প্রেম, কে.কে মেননের উপস্থিতি, আন্ডাররেটেড অভিনেতা শরমন যোশীর অভিনয় আর মন কেমন করা গান। সেই সময়ে বলিউডে ‘অ্যান্থলজি’ ফিল্ম খুব বেশি এক্সপ্লোরও হয়নি। কিন্তু ২০২৫ সালে দাড়িয়ে ‘মেট্রো ইন দিনো’ ছবিতে এই প্যাকেজটা যে সাজে এল, সেটা যেন একটু এলোমেলোই লাগল আমার।
ছবির শুরুতে প্রায় দশ-পনেরো মিনিট ধরে লাইভ ব্যান্ড গানের পারফরমেন্সের মধ্য দিয়ে চরিত্রদের সঙ্গে আলাপ করানো হল এবং গোটা ছবিজুড়ে, এদের গল্প গানের মধ্যে দিয়েই বলা হয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে চরিত্ররাই গান গেয়ে উঠছেন ছড়ার ছলে। একটা মুহূর্ত সেভাবে তৈরি হয়ে ওঠার আগেই চলে আসছে গান এবং ছড়া।
যে সব দৃশ্য নীরব থেকেই পূর্ণ হয়ে ওঠে সেখানে ব্যাকগ্রাউন্ডের ক্যাকাফোনি ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে বারবার। তবু এই ছবিকে বাঁচিয়ে দেয় আবেগ, যেটা অনুরাগ বসুর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। নানারকম ডিস্ট্র্যাকশন সত্ত্বেও একটা সূক্ষ্ম মন নিয়ে এই ছবিটা তৈরি করতে চেয়েছেন সেটা বোঝা যায়।কাজল আর মন্টির মেয়ে স্কুলে পড়ে।
মেয়েটি বুঝতে পারে না, ক্লাসের ছেলেটা নাকি মেয়েটাকে তার পছন্দ! সে নানাভাবে বোঝার চেষ্টা করে নিজের মতো করে। একবার ছেলেটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়, আবার কখনও মেয়েটির সঙ্গে। অ্যাডলেসেন্সের কনফিউশন নিজের মতো করে বুঝে নিতে থাকে। যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, একটি কুইয়ার চাইল্ড দেখাতে গিয়ে পরিচালক অনুরাগ বসু কখনোই তার ‘এজেন্সি’ কেড়ে নেয়নি। মেয়েটির বয়স অল্প হতে পারে কিন্তু রিমোট কন্ট্রোল তার হাতেই। এবং আরও একটি প্রথাভাঙা কাজ করেছেন পরিচালক।
সেটি হল, ছবিতে মেয়েটির যে ছেলে বন্ধু তার মধ্যে এমপ্যাথি দেখিয়ে। সচরাচর চেনা ট্রোপ হল এমন একজন কুইয়ার ছাত্রীকে বুলি করা হবে, ভিকটিম বানানো হবে। অনুরাগ বসুকে ধন্যবাদ তিনি সেটা এই ছবিতে করেননি।
‘মেট্রো ইন দিনো’র আরও একটি ভালো লাগার জায়গা হল যেভাবে কাজল আর মন্টির গল্প লেখা হয়েছে। প্রেম, হিউমার, হার্টব্রেক, পরকীয়া, ভালোবাসা, অভিমানের নানা রং বুনে দেওয়া হয়েছে তাদের দাম্পত্যে। হ্যাঁ, একদম ঠিক ধরেছেন, এই গল্পের প্রতিটি দৃশ্যে বারবার মনে পড়বে প্রয়াত ইরফান খানকে।
পঙ্কজ ত্রিপাঠী ভালো অভিনেতা কিন্তু তার কপাল খারাপ তিনি এসেছেন ইরফানের জায়গায়। ইরফান খানকে আসলে রিপ্লেস করা যায় না। এই ছবি দেখতে দেখতে তাঁকে বারবার মনে পড়ছিল। কঙ্কনা তার স্বাভাবিক স্বতস্ফূর্ত অভিনয় দিয়ে মন জয় করে নেন।
তাদের প্রেম লুকিয়ে আছে অভ্যেসে, মনোটনিতে ,প্রতিদিনকার ঝগড়ায়— আসলে যেকোনও স্টেবল ম্যাচিউর সম্পর্ক তাই হয়, খানিকটা বোরিং, খানিকটা শান্তিরও। একটি স্কুটি চেজিং সিকোয়েন্সে, ‘মেন আর ডগস’— বলে যখন চিৎকার করে কাজল, একটাও প্রতিবাদ না করে মেনে নেয় তার হাজব্যান্ড মন্টি। দুজনের এই লুকোচুরির সিকোয়েন্স পর্দায় মজাই লাগে দেখতে।
বাকি দুটো গল্পেও কাজলের মতো তার বোন চুমকি এবং মা শিবানী এগিয়ে এসে নিজের জীবনের হাল ধরে। এই ছবিতে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি যেমন আছে, তেমনই আছে পুরুষদের দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ার কথা, ঠিক তেমনই পুরুষদের নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে তারা সেকেন্ড চান্স পাওয়ার যোগ্য কিনা। পুরুষ বা মহিলা চরিত্র কেউ খুব ভালো বা খারাপ নয়। কেউ ভিকটিম নয়, হয়তো নিজেকে খুঁজে পেতে সময় লেগেছে এই যা।
প্রথমভাগে ছবির রাশ হাত থেকে ফসকে গেলেও দ্বিতীয়ার্ধে অনেকটা ড্যামেজ রিকভারি করেছেন পরিচালক অনুরাগ বসু। যদিও আমার কাছে এগিয়ে রইল ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’। এবার চুমকি ও শিবানীর গল্প জানতে হলে প্রেক্ষাগৃহে ছবিটা দেখতে হবে।
এমআর