সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্তে স্বাধীন নন দেশের ৭৭ শতাংশ নারী

সন্তান কখন এবং কয়টি নেওয়া হবে— এই মৌলিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারছেন না দেশের অধিকাংশ নারী। জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ’র সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭৭ শতাংশ নারী সন্তান নেওয়ার বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। বিশ্বে এই হার ৬৬ শতাংশ হলেও, বাংলাদেশে তা আরও উদ্বেগজনক। প্রজনন অধিকার নিয়ে এই স্বাধীনতার অভাবকে ‘আসল সংকট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি।

সোমবার (৭ জুলাই) রাজধানীর গুলশান-২ এ জাতিসংঘ ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিপোর্ট ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল— ‘প্রজনন স্বাধীনতা: পছন্দের সুযোগ, সংখ্যার নয়।’

অনুষ্ঠানে ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং বলেন, এই বছরের প্রতিবেদন প্রচলিত ‘অতিরিক্ত’ কিংবা ‘অপর্যাপ্ত’ জন্মসংখ্যার ধারণা থেকে সরে এসে আসল সমস্যার দিকে আঙুল তুলেছে—তা হলো নারী ও তরুণদের প্রজনন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বাধীনতার অভাব।

বিশ্বজুড়ে ১৪টি দেশে পরিচালিত জরিপ ও বাংলাদেশের জন্য ২০২২ সালের বিডিএইচএস-এর তথ্য ব্যবহার করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়—৪৫ শতাংশ মানুষই নিশ্চিত নন তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সন্তানসংখ্যা অর্জন করতে পারবেন কি না। ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ মনে করেন, তারা তাদের প্রত্যাশিত সংখ্যক সন্তানের তুলনায় কম সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

অন্যদিকে, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণও একটি বড় বাস্তবতা। বাংলাদেশে প্রতি তিন নারীর একজন কখনো না কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হন। এতে বোঝা যায়, একই নারীই একদিকে কাঙ্ক্ষিত সন্তান পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন, আবার অনাকাঙ্ক্ষিত মাতৃত্ব বরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন—যা প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতারই প্রতিচ্ছবি।

প্রতিবেদন বলছে, মানুষ সন্তান নিতে পারছেন না মূলত চারটি কারণে। এরমধ্যে ৩৯% অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সন্তান নিতে পারছেন না, ২৪% স্বাস্থ্যসেবা সীমাবদ্ধতায় ভুগছেন, ২৪% ভালো জীবনসঙ্গীর অনুপস্থিতিতে সন্তান ধারণে অনীহা এবং ১৯% ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে সন্তান নিতে চান না।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নারীদের প্রজনন অধিকার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ১১% নারী এখনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, ২৫% নারী নিজের চিকিৎসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না এবং ২৪% নারী যৌন সম্পর্কে অসম্মতির অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না।

প্রতিবেদনটি স্পষ্ট করে দিয়েছে—আলোচনার কেন্দ্রে থাকা উচিত সংখ্যা নয়, বরং ব্যক্তির অধিকার। শিশুর সংখ্যা নয়, বরং সেই সন্তান ধারণের পেছনে থাকা নারীর পছন্দ, সম্মতি, নিরাপত্তা ও মর্যাদাই এখন প্রজনন ন্যায়বিচারের মূল প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত।

এসব প্রসঙ্গে ইউএনএফপিএ প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং বলেন, স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির মাত্র ০.৭% এবং মোট বাজেটের মাত্র ২% বরাদ্দ থাকায় বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, দক্ষ মিডওয়াইফ বা জীবনরক্ষাকারী ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

তার মতে, বাজেট বরাদ্দ যথাক্রমে ৫% ও ১৫% পর্যন্ত বাড়ানো জরুরি।

প্রসঙ্গত, বিশ্ব জনসংখ্যা এখন ৮.২ বিলিয়ন। বাংলাদেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৫৭ লাখ, যার অর্ধেকই নারী। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কর্মক্ষম বয়সে রয়েছেন—ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সম্ভাবনা তৈরি হলেও, একই সঙ্গে ৭ শতাংশ মানুষ (প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ) ৬৫ বছরের বেশি বয়সী, যা বার্ধক্যজনিত সংকটের পূর্বাভাস দিচ্ছে।

এছাড়া, কিশোর-কিশোরী (১০-১৯ বছর) রয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ এবং ১০-২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি—যাদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এখনই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ জরুরি।

এফপি/ টিএ  

Share this news on:

সর্বশেষ

img
৪১ বছর বয়সেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন আন্তর্জাতিক আম্পায়ার Jul 08, 2025
img
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত, জানালেন ট্রাম্প Jul 08, 2025
img
পাকিস্তানে ভারী বৃষ্টির বন্যায় ১৯ জনের প্রাণহানি Jul 08, 2025
img
উইন-উইন সমাধানে ওয়াশিংটনের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করতে আগ্রহী ঢাকা: প্রেস সচিব Jul 08, 2025
img
জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে জাতীয় পার্টি Jul 08, 2025
img
তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ, এনজিও মালিককে বেঁধে রাখলেন গ্রাহকরা Jul 08, 2025
মহররম মাসের সত্য ঘটনা | ইসলামিক জ্ঞান Jul 08, 2025
img
উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মাসুদ কামাল Jul 08, 2025
img
সাংবাদিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে হুমকি, অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের নিন্দা Jul 08, 2025
img
ক্লাব বিশ্বকাপে চমক দেখিয়ে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার প্রিমিয়ার লিগে Jul 08, 2025
img
ঢাকাসহ দেশের ৪ বিভাগে অতি ভারী বৃষ্টির আভাস Jul 08, 2025
img
জিপিই'র প্রতিবেদন: সহিংসতার ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ২০.১ ট্রিলিয়ন ডলার Jul 08, 2025
img
ফেদেরারের সামনে হারের অভিশাপ কাটিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে জোকোভিচ Jul 08, 2025
জাপার মহাসচিবসহ ৭ দিনে ১১ নেতাকে অব্যাহতি Jul 08, 2025
img
আমরা এখনও দখল-দাপট ও অপরাধের মধ্যেই ডুবে আছি : জিল্লুর রহমান Jul 08, 2025
img
ইরান থেকে ফিরলেন আরও ৩২ জন বাংলাদেশি Jul 08, 2025
img
এস আলম গ্রুপের ১১ একর সম্পত্তি নিলামে তুলছে ইসলামী ব্যাংক Jul 08, 2025
img
ইরান টানা দুই বছর ধরে প্রতিদিন ইসরায়েলে হামলা চালাতে পারবে: উপদেষ্টা ইব্রাহিম জাব্বারি Jul 08, 2025
img
অর্থ ব্যয়ে অনিয়মের অনুসন্ধানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে দুদকের অভিযান Jul 08, 2025
img
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ২ নেতাকে শোকজ Jul 08, 2025