ঢাকাই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম উজ্জ্বল নাম সারাহ বেগম কবরী। মাত্র ১৩ বছর বয়সে কিশোরী কবরীর রূপালী পর্দায় আবির্ভাব ঘটে, আর সেখান থেকেই শুরু হয় তার রঙিন ভুবনের যাত্রা। অভিনয়গুণ, সৌন্দর্য ও সারল্যে মুগ্ধ করেছিলেন প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। পেয়েছিলেন ‘মিষ্টি মেয়ে’ উপাধি, যা হয়ে উঠেছিল তার নামেরই আরেক পরিচয়। আজ ১৯ জুলাই, এই কিংবদন্তি অভিনেত্রীর জন্মদিনে তাকে স্মরণ করছে বাংলা সিনেমার ভক্তরা।
কবরীর চলচ্চিত্রে পথচলা শুরু হয়েছিল ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে, যা মুক্তির পরই দর্শকদের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলেছিল। এরপর একে একে ‘সারেং বৌ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সুজন সখী’র মতো অসংখ্য কালজয়ী সিনেমায় তিনি উপহার দিয়েছেন অনবদ্য অভিনয়। খুব অল্প সময়েই দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। শুধু অভিনয়েই নয়, প্রযোজক ও নির্মাতা হিসেবেও রেখেছেন নিজের দক্ষতার ছাপ। কবরীর দীর্ঘ কর্মজীবন তাই পরিণত হয়েছে এক বিস্ময়কর সফলতার কাহিনিতে, যা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জেনে নেওয়া যাক কবরীর অভিনেত্রী হয়ে ওঠার সূচনা লগ্নের কথা। নির্মাতা সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ সিনেমার ‘জরিনা’ চরিত্রের জন্য একটি মেয়ের সন্ধান করছিলেন। ঠিক সেই সময়ে কবরীর সন্ধান দিলেন সিনেমাটির সংগীত পরিচালক সত্য সাহা। তবে বেঁকে বসলেন কবরী মা। তিনি মেয়েকে সিনেমার কাজে যেতে সম্মতি দিচ্ছেন না।
জীবদ্দশায় কবরী তার অভিনেত্রীর হয়ে ওঠার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মা কান্নাকাটি করে বাবাকে বললেন, “আমার দুধের শিশুকে আমি দেব না।” আমারও মা-ভাই-বোনদের ছেড়ে ঢাকায় আসতে ভালো লাগছিল না। মায়ের কান্না দেখে আমিও কাঁদতে শুরু করলাম। বাবা বুঝিয়ে বললেন, “ওরা ডেকেছে। আগে মিনা যাক। যদি ভালো না লাগে, তাহলে চলে আসবে।” এই বলে বাবা আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে রওনা হলেন।’সেই সময়ে কবরী ১৩ বছরের কিশোরী।
কবরী সিনেমার জন্য প্রথমবার ঢাকায় এসে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তিনি বাবার সঙ্গে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। থাকার জন্য পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে উঠেছিলেন। ‘ঢাকায় এসে তিনি প্রথম টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজারও অভিজ্ঞা অর্জন করেন। এসব কথা তিনি তার লেখা স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ ‘স্মৃতিটুকু থাক’বইতে লিখেছেন।
সিনেমায় কবীর অভিনয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর শুরু হলো নাম নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা। নির্মাতা সুভাষ দত্ত লেখক সৈয়দ শামসুল হককে অনুরোধ করেছেন একটা নাম ঠিক করে দিতে। এসময় দেখা গেল যে, নামেরই প্রস্তাব আসে, সেই নামে কেউ না কেউ রয়েছেন। এভাবে একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ‘করবী’ নামটি রাখার ব্যাপারে। এতে কেউ একজন বললেন ‘কবরী’ হলে ভালো হয়। অবশেষে দুটি নাম নিয়ে ভোটাভোটির আয়োজন করা হয়। এতে ‘কবরী’ নামটিই চূড়ান্ত করা যায়। এভাবে ‘মিনা পাল’ থেকে তিনি হয়ে ‘কবরী’ হয়ে যান।
কবরী অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘সুতরাং’ ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। এটির মাধ্যমেই তিনি ‘মিষ্টি মেয়ে’ হয়ে ওঠেন। কবরীর ক্যারিয়ারে নারী ‘সারেং বৌ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা। এটি চরিত্রপ্রধান চলচ্চিত্র ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি এদেশের গ্রামীণ নারীর সংগ্রাম উঠে এসেছে। কবরী সার্থকভাবে চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলেন। চরিত্রটি করেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। অভিনেত্রী হিসেবে এটিই তার একমাত্র জাতীয় পুরস্কার। সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। নায়ক ফারুক এতে কবরীর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন।
কবরী অভিনীত অনেক কালজয়ী সিনেমার মধ্যে, ‘হীরামন’, ‘চোরাবালি’, ‘পারুলের সংসার’, ‘বিনিময়’, ‘রংবাজ’, ‘বধূ বিদায়’, ‘আগন্তুক’, ‘বাহানা’ ও উল্লেখযোগ্য।
কবরী ২০০৬ সালে ‘আয়না’ নামের সিনেমা দিয়ে নির্মাণে নাম লেখান। তবে সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা সফল হয়নি। এতে ফেরদৌসের বিপরীতে অভিনেত্রী সোহানা সাবা অভিনয় করেন। এরপর প্রায় ১৫ বছর বিরতি নিয়ে ২০২০ সালে আবার সিনেমা নির্মাণের কাজে হাত দেন কবরী। সিনেমাটির নাম ‘এই তুমি সেই তুমি’। এটির কাজ প্রায় শেষের পথে থাকলেও সিনেমাটির সমাপ্তি দেখে যেতে পারেননি তিনি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল ৭১ বছর বয়সে কবরী অনন্তের পথে যাত্রা করেন।
কেএন/টিএ