মাহমুদ দারউইশ: নির্বাসনের বুকে ফুটে ওঠা কবিতার ফুল

ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত ভোরে, যখন ভূমির শিয়রে বুলডোজারের চাকা গড়ায় আর হাওয়ায় ভেসে আসে নির্বাসনের গন্ধ-ঠিক তখনই ইতিহাসের গভীর থেকে একটি কণ্ঠ ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে, যার শব্দ ছিল শান্ত অথচ দৃঢ়; যার ভাষা ছিল কোমল অথচ অভেদ্য। সেই কণ্ঠ মাহমুদ দারউইশের-যিনি কবিতায় গেঁথে রেখেছিলেন স্বদেশ, স্মৃতি, প্রেম, প্রতিরোধ এবং এক নামহীন পরিচয়ের দাবিদার মানুষের দীর্ঘশ্বাস।

তিনি জন্মেছিলেন ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ ব্রিটিশ অধিকৃত প্যালেস্টাইনের গালিলীয় অঞ্চলের আল-বিরওয়া গ্রামে। সেই গ্রাম আর নেই-ইসরায়েলি আগ্রাসনের অভিঘাতে তা বিলুপ্ত। মাত্র সাত বছর বয়সেই তাঁকে পরিবারসহ উদ্বাস্তুর জীবন নিতে হয়। লেবাননে পালিয়ে যাওয়া, আবার গোপনে ফিরে এসে ‘অবৈধ’ আরব হিসেবে জীবন যাপন-এই অভিজ্ঞতা যেন জীবনের শুরুতেই তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছিল, কীভাবে মানুষ চুপচাপ হারিয়ে যায় কাগজপত্রের গোলকধাঁধায়। অথচ তাঁর কলম হারিয়ে যাওয়া মানুষদের আত্মা ধরে রাখতে শিখে গিয়েছিল।

তাঁর প্রথম কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলোতে যে কান্না ছিল, তা ছিল নিঃশব্দ-কিন্তু তীক্ষ্ণ। “Write Down, I am an Arab”-এই একটি কবিতাতেই যেন জমে আছে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব রক্ষার এক প্রতীকী যুদ্ধ। তাতে নেই অস্ত্রের ঝনঝনানি, নেই রক্তের প্রতিশোধ—আছে নিজের নামটুকু লিখে রাখার এক নিষ্পাপ অথচ বিদ্রোহী আবেদন।

তাঁর কবিতা মানেই যেন একটি স্বদেশহীন আত্মার গান। তাতে ‘দেশ’ বলতে আমরা যা বুঝি-সীমারেখা, পতাকা কিংবা সংবিধান-তার কিছু নেই। আছে মায়ের মুখ, childhood memory-তে দেখা এক টুকরো আঙিনা, একটি পুরনো লেবু গাছ কিংবা পুরোনো কাগজে ভাঁজ করা সেই চিঠি, যেটি কোনোদিন পোস্ট হয়নি। ফিলিস্তিন তাঁর কবিতায় হয়ে ওঠে এক বিস্মৃত প্রেমিকা-যাকে কখনও কাছে পাওয়া যায় না, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে যে হৃদয়ের গভীরে স্পন্দিত হয়।

মাহমুদ দারউইশ শুধুই কবি ছিলেন না, ছিলেন এক অস্তিত্ববাদী যোদ্ধা-যার যুদ্ধক্ষেত্র ছিল কাগজ, অস্ত্র ছিল কলম, আর গোলাবারুদ ছিল শব্দ। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের অংশ, ছিলেন পিএলও-এর নির্বাহী সদস্য। কিন্তু কখনোই কূটনীতির মোড়কে স্বপ্ন বিকিয়ে দেননি। অসলো চুক্তির পরে তিনি যখন পদত্যাগ করেন, তা যেন এক নীরব ঘোষণাই ছিল-“আমি রাষ্ট্র চাই, কিন্তু শর্তহীন, বিক্রয়হীন, স্মৃতিবিহীন নয়”।

তাঁর কবিতা ‘রাজনীতি’ নামক শব্দের সংকীর্ণতা ছাড়িয়ে আত্ম-অন্বেষণের উচ্চতায় উঠে যায়। সেখানে দেখা যায়, মাতৃভূমিকে খুঁজতে খুঁজতে কবি কখনো প্রেমিক হয়ে ওঠেন, কখনো সন্তান, আবার কখনো সেই কৃষক, যে গোপনে তার কাটা ফসলের ওপর দিয়ে হাত বুলিয়ে বলে—"তুমি এখন আমার নয়, তবে আমারই ছিলে।" যেমন লিখেছেন-

 “If the olive trees knew the hands that planted them,
their oil would become tears.”

এই একটি পঙ্‌ক্তিতে কী গভীর ব্যথা! যেন মাটি নিজেই কাঁদে, যদি সে জানে তার শরীরে কাদের রক্ত মিশে আছে।

দারউইশের প্রেমের কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায়, তিনি ভালোবাসতেন এমনভাবে-যেমনভাবে কেউ তার হারানো স্বদেশকে ভালোবাসে। তাঁর ‘Rita and the Rifle’ কবিতায় প্রেমিকার নামের পাশে বন্দুক এসে দাঁড়ায়—সেই প্রেম অসম্পূর্ণ, আবার তীব্র। Rita এখানে কেবল প্রেমিকা নন, এক বিভাজিত ভূমির প্রতীক, এক রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সীমারেখা। তাঁর প্রেম-জ্যোতির্ময়, কিন্তু দুঃখভারাক্রান্ত।

তাঁর কাব্যগ্রন্থ “A Lover from Palestine”, “The Butterfly’s Burden”, কিংবা “Memory for Forgetfulness”-এই সব কাব্য যেন দেশহীন এক মানবাত্মার ব্যক্তিগত ডায়েরি। সেই ডায়েরিতে পৃষ্ঠা ওল্টালেই চোখে পড়ে শহর ধ্বংসের চিত্র, আবার তার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় এক শিশুর জন্মদিনের কথা-যে শিশু জন্মেছিল বোমার শব্দের মধ্যে, কিন্তু তার চোখে ছিল কেবল রঙিন ঘুড়ির স্বপ্ন।

২০০৮ সালের ৯ আগস্ট, আমেরিকার হিউস্টনে তাঁর হৃদযন্ত্র থেমে যায়। কিন্তু তাঁর কবিতা থামেনি। মৃত্যু তাঁকে বন্ধ করে রাখতে পারেনি-বরং তাঁর ভাষা হয়ে উঠেছে আরও উদার, আরও প্রতিধ্বনিময়। আজ যখন গাজার আকাশে আবারো আগুনের রেখা আঁকে যুদ্ধবিমান, তখনো কোনো একটি আশ্রয়কেন্দ্রে হয়তো কেউ দারউইশের কবিতা পড়ছে মোমের আলোয়। কারণ, তাঁর কবিতা শিখিয়েছে-দেশ হারালেও স্বপ্ন হারানো উচিত নয়, অস্তিত্ব হারালেও কবিতা লেখা থেমে থাকা উচিত নয়।

তিনি সেই কবি, যিনি বলেছিলেন-“Exile is more than geography”-অর্থাৎ, নির্বাসন কেবল স্থানচ্যুতি নয়, তা এক আত্মিক বিচ্ছেদ। তিনি শিখিয়েছেন, স্বদেশ মানে শুধু জন্মস্থান নয়-স্বদেশ মানে স্মৃতি, মানে আশ্রয়, মানে নিজের অস্তিত্বকে স্বীকার করার অধিকার।

এজন্যই মাহমুদ দারউইশকে মনে রাখতে হয়। শুধু ফিলিস্তিনিরা নয়, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, যে তার নিজের মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন, যে তার নিজের নাম ভুলে যাচ্ছে রাষ্ট্রের কোনো দালিলে, যে প্রেম করতে চায় কিন্তু কোনো বাধা তাকে সে প্রেম থেকে সরিয়ে নেয়-তারা সকলেই দারউইশের কবিতায় নিজেকে খুঁজে পায়।

তাঁর কবিতা সময়কে অতিক্রম করে, স্থানকে অগ্রাহ্য করে, কেবল ‘মানুষ’ নামক অস্তিত্বের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। সেই মানুষের চোখে জল, হাতে কবিতা, মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন-যা কোনো সেনা, কোনো কাঁটাতার, কোনো রাষ্ট্রের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি থামাতে পারে না।

এই জন্যই, মৃত্যুর এত বছর পরেও মাহমুদ দারউইশ এখনো বেঁচে আছেন-প্রতিটি নির্বাসিত হৃদয়ের কাছে, প্রতিটি স্বপ্নভঙ্গের কান্নায়, প্রতিটি প্রতিরোধী কবিতার ভেতরে। তিনি বেঁচে আছেন-যতদিন শব্দ থাকবে, যতদিন ভালোবাসা থাকবে, যতদিন কেউ নিজের পরিচয় খুঁজে বেড়াবে মাটির গন্ধে।

লেখক:
    বাহাউদ্দিন গোলাপ
     ডেপুটি রেজিস্ট্রার
     বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

Share this news on:

সর্বশেষ

img
শাহবাগ মোড়ে ছাত্র-জনতার ফজরের নামাজ আদায় Dec 19, 2025
img
হাদির মৃত্যুর প্রতিবাদে সকালেও স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল শাহবাগ Dec 19, 2025
img
প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের আগুন নিয়ন্ত্রণে Dec 19, 2025
img
ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে গভীর রাতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ Dec 19, 2025
img
রাতভর অবরোধের পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছাড়লেন আন্দোলনকারীরা Dec 19, 2025
img
ওসমান হাদিকে জাতীয় কবরস্থানে দাফনের দাবি জানিয়েছেন আবরার ফাইয়াজ Dec 19, 2025
img
২৪ ঘণ্টায় পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ২০৪২ Dec 19, 2025
img
হাদি সময়ের সক্রিয় ও সাহসী কণ্ঠস্বর: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব Dec 19, 2025
img
নাসার নতুন প্রধান জ্যারেড আইজ্যাকম্যান Dec 19, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের পর ভেনেজুয়েলার পাশে থাকার ঘোষণা চীনের Dec 19, 2025
img
যশোরে আওয়ামী লীগের ১৫ নেতাকর্মী আটক Dec 19, 2025
img
বান্দরবানে সাবেক মন্ত্রী বীর বাহাদুরের বাসভবনে আগুন Dec 19, 2025
img
ওসমান হাদির মৃত্যু: সারা দেশে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ Dec 19, 2025
img
কারও উসকানিতে পা না দিতে আহ্বান সংস্কৃতি উপদেষ্টার Dec 19, 2025
img
হাদির মৃত্যুর খবরে উত্তাল চট্টগ্রাম Dec 19, 2025
img
হাদির মৃত্যুর সংবাদ প্রধান উপদেষ্টাকে জানান সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী Dec 19, 2025
img
হাদির খুনিদের হস্তান্তর না করলে আন্দোলন আরও তীব্র হবে: আসিফ Dec 19, 2025
img
চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের বাসভবনে হামলার চেষ্টা, গ্রেপ্তার ১২ Dec 19, 2025
img
ওসমান হাদির মৃত্যুতে চরমোনাই পিরের শোক Dec 19, 2025
img
দেশপ্রেমের প্রশ্নে অটল হাদি এক অবিচল সাহসের নাম : নাসির উদ্দিন নাসির Dec 19, 2025