এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে হতাশ হয়ে খাতা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন বহু শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ফেল করা ৩ হাজার ৯২৫ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। এর মধ্যে সাতজন ফেল থেকে সরাসরি জিপিএ-৫ পেয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে পাস করা অনেকের ফলাফল। আগের প্রাপ্ত জিপিএ বেড়ে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৪৫ জন শিক্ষার্থীসব মিলিয়ে পুনঃনিরীক্ষণে ফল পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে ১৫ হাজার ২৪৩টি —যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭১ শতাংশ বেশি। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। তারা মনে করছেন ফল পরিবর্তনের এ পরিসংখ্যান খাতা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার গাফিলতি ও তাড়াহুড়ো স্পষ্ট করে দিচ্ছে।
বোর্ডভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফেল থেকে পাসের সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, যেখানে ২ হাজার ৬৫৪ জন ফেল থেকে পাস করেছে। এরপর মাদ্রাসা বোর্ডে ৯৯১ জন নতুন করে পাস করেছে। এছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ২৯৩ জন, ময়মনসিংহে ২১০ জন, কুমিল্লায় ১৯০ জন, যশোরে ১৮৭ জন, রাজশাহীতে ৪৮ জন, চট্টগ্রামে ৬৪ জন, দিনাজপুরে ৯৯ জন, সিলেটে ৩০ জন এবং বরিশালে ২৬ জন শিক্ষার্থী ফেল থেকে পাস করেছে।
নতুন করে জিপিএ-৫ পাওয়া ১ হাজার ৪৫ জনের মধ্যে ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থী সর্বাধিক। যার সংখ্যা ২৮৬ জন। এরপর যশোরে ২৭১ জন, ময়মনসিংহে ১৬৬ জন, মাদ্রাসায় ১৩৯ জন, কুমিল্লায় ৬৭ জন, চট্টগ্রামে ৬৫ জন, দিনাজপুরে ৫৭ জন, রাজশাহীতে ৩৫ জন, বরিশালে ২৬ জন, সিলেটে ২২ জন এবং কারিগরি বোর্ডে ১২ জন।
অন্যদিকে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন এবং ফল পরিবর্তনের ঘটনা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৭১ শতাংশ। শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে খাতা পুনঃনিরীক্ষণের পর ফল পরিবর্তনের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৮৭৫, ২০২৩ সালে ছিল ১১ হাজার ৩৬২। আর ২০২৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার ২৪৩। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে এ সংখ্যায় পরিবর্তন হয়েছে ৬ হাজার ৩৬৮টি।
ফেল হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢাকা ও কারিগরি বোর্ডে তিনজন করে ছয়জন এবং ময়মনসিংহ বোর্ডে একজন শিক্ষার্থী নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন পাওয়ার পর শিক্ষা বোর্ডগুলো প্রতিটি উত্তরপত্র খুব সাবধানে পর্যবেক্ষণ করে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রথমত, বোর্ড নিশ্চিত করে যে প্রতিটি প্রশ্নের জন্য নম্বর সঠিকভাবে দেওয়া হয়েছে কি না। দ্বিতীয়ত, প্রশ্নের সব নম্বরের যোগফল সঠিক রয়েছে কি না তা যাচাই করে। তৃতীয়ত, প্রাপ্ত নম্বর যথাযথভাবে ওএমআর শিটে উঠে এসেছে কি না তা পর্যালোচনা করে এবং চতুর্থত, ওএমআর শিটের বৃত্ত ঠিকভাবে ভরাট করা হয়েছে কি না—এটাও বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা হয়।
এসব পর্যবেক্ষণ করে বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় যে কোন কোন ক্ষেত্রে পরীক্ষার ভুল সংশোধন সম্ভব। তবে বোর্ড স্পষ্টভাবে জানায় যে, পরীক্ষক যেভাবে নম্বর দিয়েছেন সেই নম্বরের পরিমাণ বাড়ানো যায় না। যেমন— কোনো প্রশ্নে ৬ নম্বর দেওয়া থাকলে সেটি ৮ নম্বর করা যাবে না, শুধুমাত্র ভুলবশত নম্বর কম দেওয়া থাকলে সেটি ঠিক করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে এই খাতাগুলো পুনঃনিরীক্ষণের জন্য অন্য পরীক্ষকের হাতে দেওয়া হয়, তারা প্রথম পরীক্ষকের ভুল এবং ত্রুটি মন্তব্যের মাধ্যমে শনাক্ত করে বোর্ডকে জানান।
খাতা পুনঃনিরীক্ষণে ফলাফল পরিবর্তনের যে হার তাতে পরিষ্কার যে, প্রথমবার খাতা দেখার সময় গাফিলতি ছিল। পরীক্ষকরা খাতার নম্বরের যোগফল ভুল করছেন, ওএমআর শিটে ভুল তথ্য উঠছে এবং নম্বর যোগফলে ত্রুটি হচ্ছে। এই ভুলগুলো কেন বারবার হচ্ছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর একটি স্কুলের একজন প্রধান পরীক্ষক জানান, আমাদের ওপর চাপ এত বেশি যে, একজন পরীক্ষককে ৫০০ থেকে ৬০০ খাতা মাত্র ১০-১২ দিনের মধ্যে মূল্যায়ন করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে তাড়াহুড়ো ও অসাবধানতায় ভুল স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। আমরা যত যত্ন নিতে চাই, এত সীমিত সময়ে তা সম্ভব হয় না।
তিনি আরও বলেন, পরীক্ষা মূল্যায়নের সময় বাড়ানোর কোনো ব্যবস্থা না থাকলে, শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। ভুলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই ক্ষতির দায় বোর্ডের পক্ষ থেকে এখনো স্বীকার করা হয়নি। এই নীরবতা শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্যায়।
বোর্ডের কর্মকর্তাদের মতেও, সময়ের চাপই ভুলের অন্যতম কারণ। পরীক্ষা শেষে মাত্র ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকায় একজন পরীক্ষককে ১০–১২ দিনের মধ্যে ৫০০–৬০০টি খাতা মূল্যায়ন করতে হয়। এতে তাড়াহুড়ো করে নম্বর যোগ করা বা ডাটা এন্ট্রিতে ভুল হয়। বিশেষ করে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো মৌলিক বিষয়ে বেশি আবেদন আসে। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বোর্ডে শুধু গণিতে ৪২ হাজার ৯৩৬টি খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন হয়েছে।
দায়িত্বশীলরা বলছেন, খাতা মূল্যায়নে গাফিলতি প্রমাণিত হলে পরীক্ষকদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়—কেউ এক বছরের জন্য, কেউ স্থায়ীভাবে। গুরুতর ক্ষেত্রে বেতন-ভাতা বন্ধ বা ফৌজদারি মামলার সুপারিশও করা হয়। পুনঃনিরীক্ষণের সময় তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষকরা প্রথম পরীক্ষকের ভুল লিখিতভাবে নথিভুক্ত করেন। যা ধরেই দায়ী পরীক্ষকদের শনাক্ত করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, এবার পুনঃনিরীক্ষণে আমরা সতর্ক ছিলাম যাতে কোনো শিক্ষার্থী দ্বিতীয়বার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। পরীক্ষকদের গাফিলতি কমানোর চেষ্টা চলছে। তবে খাতা অন্য কাউকে দিয়ে মূল্যায়নের বিষয়ে শূন্য সহনশীলতা নীতি বজায় রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, খাতা দেখায় কেউ গাফিলতি করলে পরীক্ষা আইনে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া যায়। তবে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী কালো তালিকাভুক্ত বেশি করা হয়। বোর্ড কোনো শাস্তি দিতে পারে না। তাই অপরাধের মাত্রা বেশি হলে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়ে থাকে।
পুনঃনিরীক্ষণের মাধ্যমে ভুল সংশোধনের সুযোগ পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক সন্তুষ্ট হলেও তারা স্বচ্ছতা ও নির্ভুল মূল্যায়নে বোর্ডের বা মন্ত্রণালয়ের আরও যত্ন ও নজরদারি চান।
রবিউল ইসলাম নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বলেন, খাতা চ্যালেঞ্জ করার পর আমার ফল বদলেছে, এটা আমার জন্য খুব বড় প্রাপ্তি। তবে আশা করি ভবিষ্যতে খাতা মূল্যায়নের সময় বাড়ানো হবে যাতে ভুলের সুযোগ কমে আসে এবং আমরা সঠিক ও মানসম্মত নম্বর পেতে পারি।
সায়মা আক্তার নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ফল পরিবর্তন হলেও আমরা জানি না এই গরমিল কেন হচ্ছে। বোর্ড যদি পরীক্ষা নিরীক্ষায় আরও সময় দেয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে।
বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে মাহমুদুল হাসান নামে এক অভিভাবক বলেন, এবার পুনঃনীরিক্ষণের পর অনেকেই ভালো ফল করেছে। অথচ গত ১০ জুলাই ফল প্রকাশের পর প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল না পেয়ে দীর্ঘ এক মাস একটি খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ফল নির্ধারণের পদ্ধতি সঠিক হওয়া জরুরি। বোর্ডের ভুল ধরিয়ে দিয়ে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা ভালো লক্ষণ। আমরা চাই ভবিষ্যতে যেন এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
নুরুল ইসলাম নামে আরেক অভিভাবক বলেন, ফলের এত বেশি পরিবর্তন আমরা আগে দেখিনি। এমন ঘটনায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অনেকেই হতাশ। কারণ, পরীক্ষার ফল নির্ভরযোগ্য না হওয়ায় তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ ডিপ্রেশনে ভুগছেন।
ভবিষ্যতে এমন অবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর নজরদারি ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন চান এ অভিভাবক।
এসএন