২০০৩ সালের ১০ আগস্ট, ইতিহাসে লেখা হলো এক অনন্য ভালোবাসার গল্প। পৃথিবী থেকে ৪০০ কিলোমিটার উপরে, ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার বেগে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) প্রদক্ষিণ করছে। সেখানেই রুশ নভোচারী ইউরি ম্যালেনচেঙ্কো বললেন ‘আই ডু’। আর মাটিতে, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের নাসা জনসন স্পেস সেন্টারে দাঁড়িয়ে তার আমেরিকান বাগদত্তা একাতেরিনা দিমিত্রিয়েভও উচ্চারণ করলেন সেই একই প্রতিশ্রুতি।
এটি ছিল না কোনো প্রচারণামূলক স্টান্ট- বরং প্রেম, প্রযুক্তি ও মহাকাশ অভিযানের এক সাহসী মেলবন্ধন। জটিল আইন, প্রযুক্তিগত বাধা আর সাংস্কৃতিক ব্যবধান পেরিয়ে এই বিয়ে প্রমাণ করে দিলো- যে কোনো পরিবেশেই হৃদয় তার নিজস্ব কক্ষপথ খুঁজে নেয়।
আইএসএস হলো বহু দেশের যৌথ গবেষণাগার, যেখানে প্রতিটি মিনিট পরীক্ষানিরীক্ষা, রক্ষণাবেক্ষণ ও যোগাযোগের জন্য বরাদ্দ। বিয়ের কোনো স্থান সেখানে নেই। কিন্তু সেদিন স্টেশনের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছু সময়ের জন্য হয়ে উঠল বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যম। বিয়ের সময় আইএসএস এক কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করছিল মাত্র ৯০ মিনিটে, অর্থাৎ অনুষ্ঠান চলাকালীন সেটি একাধিক মহাদেশের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল—যেন সত্যিই ‘বিশ্বব্যাপী কভারেজ’।
ম্যালেনচেঙ্কো ছিলেন অভিজ্ঞ মহাকাশচারী, বছরের পর বছর প্রশিক্ষণ ও মিশনে বাড়ি থেকে দূরে কাটিয়েছেন। আর দিমিত্রিয়েভ, রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক, মহাকাশের প্রতি গভীর অনুরাগী। দু’জনের পরিচয় হয়েছিল মহাকাশ সংশ্লিষ্ট মহলে। একসঙ্গে কাটানোর সুযোগ কম হলেও ফোন, সফর আর মহাকাশের প্রতি যৌথ ভালোবাসা তাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিল।
প্রথমে তারা ২০০ অতিথি নিয়ে ঐতিহ্যবাহী বিয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ম্যালেনচেঙ্কোর মিশন দীর্ঘ হওয়ায় মাস নয়তো বছরের জন্য বিয়ে পিছিয়ে যেত। তাই বিলম্ব না করে রুশ মহাকাশ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তারা নিলেন সাহসী সিদ্ধান্ত- ইতিহাসের প্রথম মহাকাশ বিবাহ আয়োজন।
রুশ মহাকাশ সংস্থা রসকসমস ও নাসার সমন্বয়ে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়।
দৃশ্যমান সংযোগ: হিউস্টনে সাজানো কক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন কনে, আর বর লাইভ ভিডিওতে আইএসএস থেকে।
পোশাক: ম্যালেনচেঙ্কো পরেছিলেন আনুষ্ঠানিক মহাকাশ স্যুটে বো-টাই, আর দিমিত্রিয়েভ পরেছিলেন হাতির দাঁতের রঙের গাউন।
সংগীত: বরযাত্রী নভোচারী এড লু বাজিয়েছিলেন ওয়েডিং মার্চ।
সংস্কৃতির ছোঁয়া: কনে হেঁটে আসেন ডেভিড বোই-এর ‘স্পেস অডিটি’ গানে।
প্রতীকী মুহূর্ত: কনে ক্যামেরায় চুম্বন ছুড়ে দেন, বরও সাড়া দেন কক্ষপথ থেকে।
দিমিত্রিয়েভ পরে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘ইউরি যত দূরে ছিল, যোগাযোগের জন্য তত কাছের মনে হচ্ছিল।’ এই বিয়ে ছিল মানব অভিযোজনের প্রতীক- যে কোনো পরিবেশে মানুষ নিজের আবেগ ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারে। অনুষ্ঠান শেষে ম্যালেনচেঙ্কো আরও কয়েক মাস মহাকাশে দায়িত্ব পালন করেন। অবশেষে ২০০৩ সালের অক্টোবরে তিনি পৃথিবীতে ফিরে এসে প্রথমবারের মতো স্বামী হিসেবে স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই মিলনের ছবি আজও ইতিহাসে অম্লান।
কেএন/এসএন