বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) স্পট ফিক্সিং তদন্তে বেরিয়ে এসেছে বিস্ময়কর তথ্য। এক ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নির্দিষ্ট একটি ম্যাচ হারার শর্তে ৪০০ কোটি টাকার প্রস্তাব দিয়েছিল জুয়াড়িরা। প্রস্তাবটি তারা গ্রহণ করেছিল কি না তা নিশ্চিত হতে না পারলেও, বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে এ ঘটনা জানায়নি ফ্র্যাঞ্চাইজিটি। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি হেরে যায় দলটি।
বিসিবির তিন সদস্যের স্বাধীন তদন্ত কমিটি সর্বশেষ একাদশ বিপিএলের ফিক্সিং তদন্ত শেষ করেছে। আগামী সপ্তাহে প্রাথমিক রিপোর্ট বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলামের কাছে জমা দেওয়ার কথা। সাবেক বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দারের নেতৃত্বে থাকা কমিটির অন্য দুই সদস্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. খালেদ এইচ চৌধুরী এবং সাবেক ক্রিকেটার শাকিল কাসেম।
তদন্তকাজের অংশ হিসেবে প্রায় ৩০০ ঘণ্টা কথোপকথনের রেকর্ড লিখিত রূপে সংকলিত হয়েছে তিন হাজার পৃষ্ঠারও বেশি। এ থেকে প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি হয়েছে, যেখানে বিসিবিকে সতর্ক করার জন্য নানা সুপারিশ থাকবে। ড. খালেদ এইচ চৌধুরী বলেন, ‘প্রাথমিক রিপোর্টে আমরা মূলত আমাদের ফাইন্ডিংস উল্লেখ করব। কেন এসব হচ্ছে, এসব বন্ধে বিসিবির কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, ফ্র্যাঞ্চাইজি কাঠামো ঠিক করা—এসব ব্যাপারে আমাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ থাকবে।’
জানা গেছে, শুধু গত বিপিএলেই সন্দেহজনক ঘটনা ছিল অন্তত ৩৬টি। তদন্তে অভিযুক্ত হিসেবে নাম এসেছে ১০–১২ জন ক্রিকেটারের, যাদের মধ্যে ৩–৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘হাই ফ্ল্যাগড’ অর্থাৎ প্রায় নিশ্চিত। এদের মধ্যে দুইজন সাবেক জাতীয় দলের ক্রিকেটার, একজন পেসার ও একজন অফ স্পিনার। আরেকজন জাতীয় দলে না খেলা পেসারও আছেন, যিনি অস্বাভাবিক ওয়াইড দেওয়ার ঘটনায় আলোচনায় ছিলেন। বাকিরা ‘মিডিয়াম ফ্ল্যাগড’ ও ‘লো ফ্ল্যাগড’, অর্থাৎ অভিযোগ পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও সন্দেহ দূর হয়নি।
তালিকায় সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা সফরের দলে থাকা একজন ক্রিকেটার এবং একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির কোচের নামও রয়েছে। এমনকি বিসিবির একটি সাবকমিটির এক সদস্যের নাম এসেছে, যিনি গত বিপিএলে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তদন্তে তিনটি ফ্র্যাঞ্চাইজির, দুর্বার রাজশাহী, সিলেট স্ট্রাইকার্স ও ঢাকা ক্যাপিটালস, সরাসরি স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত পাওয়া গেছে। কমিটি অধিকতর তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত এসব ফ্র্যাঞ্চাইজি, খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের বিসিবির সব ক্রিকেটীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখার সুপারিশ করবে বলে জানা গেছে।
তদন্তে আরও উঠে এসেছে, অনলাইন বেটিং বিজ্ঞাপন প্রচার করে একটি সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান ১৭০-১৮০ কোটি টাকা তুলেছে। কমিটির পর্যবেক্ষণ, এ ধরনের চ্যানেল ও সম্প্রচারকদের কাছ থেকেও বিসিবিকে দূরে থাকতে হবে, কারণ তারা পরোক্ষভাবে ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকতে পারে। এ ছাড়া দেখা গেছে, বেটিং এজেন্টরা স্টেডিয়ামের করপোরেট বক্সে বসেও খেলা দেখে, যেখানে বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিটের নজরদারি দুর্বল। বিদেশি এজেন্টদের নিরাপত্তা, থাকা ও যাতায়াতের ব্যবস্থাও এখান থেকে করা হয়। এখন অনেক বেটিং প্রতিষ্ঠান স্থানীয় এজেন্টও ব্যবহার করছে।
কমিটির তথ্য অনুযায়ী, শুধু সর্বশেষ বিপিএল নয়, গত পাঁচ আসর মিলিয়ে সন্দেহজনক ঘটনা পাওয়া গেছে ১৪০টির বেশি। স্থানীয় ও বিদেশি সন্দেহভাজন খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৬০-এর বেশি, কারও কারও নাম এসেছে একাধিকবার।
রিপোর্টে আরও সুপারিশ থাকবে-বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে ঢেলে সাজানো, জাতীয় ক্রিকেট লিগ ও প্রিমিয়ার লিগসহ ঘরোয়া সব টুর্নামেন্টে এ ইউনিট সক্রিয় রাখা এবং অনলাইন বেটিং বন্ধে বর্তমান আইন যুগোপযোগী করে সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়ন করা। কমিটি মনে করে, আইনটি এমন হওয়া দরকার যেন বিসিবি নিজেই দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।
তদন্তে সীমাবদ্ধতাও ছিল। ফরেনসিক তদন্তের সুযোগ না থাকায় অভিযুক্তদের ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখা যায়নি। কমিটির অভিযোগ, বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিট তাদের সহযোগিতা করেনি এবং আইসিসি বা বেটিং পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর পাঠানো সন্দেহজনক ঘটনার তথ্যও পায়নি কমিটি। এসব কারণে রিপোর্টে ফরেনসিক তদন্তের সুপারিশ থাকবে।
চূড়ান্ত রিপোর্ট আগামী মাসে জমা দেওয়া হবে, যেখানে বিস্তারিতভাবে অভিযুক্তদের নাম, সন্দেহজনক ঘটনা এবং প্রমাণ উল্লেখ থাকবে।
ইএ/টিকে