ভারতের নানা শহরে গড়ে উঠছে ‘আবর্জনার রেস্তোরাঁ’ (গার্বেজ ক্যাফে)। ছত্তিশগড় রাজ্যের আম্বিকাপুরেও গড়ে উঠেছে এমন এক ব্যতিক্রমী ক্যাফে, যা প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের মাধ্যমে দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করছে। স্থানীয়রা এটি ‘গার্বেজ ক্যাফে’ হিসেবে ডাকে।
প্লাস্টিক দূষণ কমানো এবং দরিদ্রদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৯ সালে এটি চালু হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য আর ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আসলে কতটা কার্যকর হতে পারে এ উদ্যোগ, তা দেখতে ছত্তিশগড় রাজ্যের আম্বিকাপুরে হাজির হয়েছিল সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
আম্বিকাপুর পৌর করপোরেশনের (এএমসি) হয়ে ক্যাফেটি পরিচালনা করেন বিনোদ কুমার প্যাটেল। তিনি বিবিসিকে জানান, এক কেজি প্লাস্টিক বর্জ্যের বিনিময়ে পুরো খাবার—ভাত, ডাল, দুই রকম সবজি, রুটি, আচার ও সালাদ—পাওয়া যায়। আধা কেজি বর্জ্য দিলে সকালের নাশতা যেমন সমুচা বা আলুর বড়া-পাউরুটি দেওয়া হয়। প্রতিদিন গড়ে ২০ জনের বেশি মানুষ এখানে খাবার পান।
স্থানীয়রা বলেন, আগে তারা প্লাস্টিক বিক্রি করে জীবনযাপন করতেন। রাশমি মণ্ডল নামের এক স্থানীয় নারী বলেন, ‘বছরের পর বছর প্লাস্টিক বিক্রি করে সংসার চালানো সম্ভব ছিল না। এখন এটি আমাদের জীবিকা ও খাবারের উৎস।’
শহরের স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা রিতেশ সাইনি বলেন, ক্যাফে শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ২৩ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ হয়েছে। শহরের ল্যান্ডফিলে প্লাস্টিকের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। যেখানে ২০১৯ সালে বছরে ৫.৪ টন প্লাস্টিক জমা হতো, ২০২৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ টনে।
আম্বিকাপুরে এখন ২০টি বর্জ্য সংগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোতে বর্জ্য আলাদা করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী আলাদা করা হয়। এখানে কাজ করেন ৪৮০ জন নারী, যারা ‘স্বচ্ছতা দিদি’ নামে পরিচিত। তারা প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্লাস্টিক ও অন্যান্য শুকনো বর্জ্য সংগ্রহ করেন।
শহরের সরকার এই উদ্যোগের পাশাপাশি বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ও প্লাস্টিক কমানোর জন্য কার্যকর নীতি চালু করেছে। সংগ্রহ করা প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাত করে রাস্তা নির্মাণে ব্যবহার বা পুনর্ব্যবহারকারীদের কাছে বিক্রি করা হয়। ভেজা বর্জ্য কম্পোস্টে রূপান্তরিত হয় এবং অব্যবহারযোগ্য সামান্য বর্জ্য সিমেন্ট কারখানায় জ্বালানি হিসেবে পাঠানো হয়। ফলে শহরটি ‘জিরো ল্যান্ডফিল’ শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
শহরের আর্কিটেকচারাল ও নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই উদ্যোগ শুধু ক্ষুধা মেটায় না, বরং শহরের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করে এবং প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সহায়তা করে। এই মডেলটি ‘আম্বিকাপুর মডেল’ নামে পরিচিতি পেয়েছে এবং রাজ্যের ৪৮টি ওয়ার্ডে চালু করা হয়েছে।
ভারতের অন্য শহরেও গার্বেজ ক্যাফের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। শিলিগুড়ি, মুলুগু, মাইসুরু এবং উত্তর প্রদেশের কিছু এলাকায় শুরু হয়েছে অনুরূপ প্রকল্প। তবে দিল্লিতে ২০২০ সালে শুরু হওয়া ক্যাফে প্রকল্প ব্যর্থ হয়। কারণ ছিল মানুষের কম সচেতনতা, পুনর্ব্যবহার অবকাঠামোর ঘাটতি এবং আর্থিকভাবে তুলনামূলক সচ্ছল মানুষদের আগ্রহ কম থাকা।
গুজরাটের আহমেদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মীনাল পাঠক বলেন, ‘এই ধরনের উদ্যোগ প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায়। তবে মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না—যেমন অতিরিক্ত প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য নয় এমন বর্জ্য উৎপাদন। এসব উদ্যোগ সহায়ক হলেও, আরও বড় পরিবর্তন দরকার।’
এ উদ্যোগ শুধু ক্ষুধা ও পরিবেশ সমস্যা সমাধান করছে না, বরং দরিদ্র ও নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করেছে। স্থানীয়রা এটিকে খাদ্য, আয় ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশের এক যুগান্তকারী সমন্বিত মডেল হিসেবে দেখছেন।
সূত্র: বিবিসি।
এফপি/টিএ