ঢাকার বুকে ছোট্ট আবাসিক এলাকা নিকুঞ্জ—একসময় যেটি ছিল শান্ত, পরিচ্ছন্ন ও নিরিবিলি বসবাসের জন্য একটি আদর্শ স্থান। চারপাশে সবুজ, প্রশস্ত রাস্তা, নিরিবিলি সকাল আর সুশৃঙ্খল পরিবেশ একে করে তুলেছিল ঢাকার ভেতরে এক অন্য রকম ঠিকানা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই চেনা চিত্র বদলে যায়। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম্যে নিকুঞ্জ ধীরে ধীরে হারায় তার স্বাভাবিক ছন্দ।
অল্প কিছু বছরের মধ্যেই নিকুঞ্জের রাস্তাগুলো ভরে ওঠে অসংখ্য ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায়। সুশৃঙ্খল পথচারীরা পড়ে যান বিশৃঙ্খলার মুখে। সকালে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সময় সৃষ্টি হতো তীব্র যানজট। বৃদ্ধ কিংবা গৃহিণীরা নিরাপদে হাঁটার সুযোগ হারান। চারদিকের বিকট হর্ন আর অগোছালো চলাচল যেন ধীরে ধীরে মানুষকে ক্লান্ত করে তুলছিল।
এমন এক পরিবেশে নিকুঞ্জবাসী বুঝতে পেরেছিলেন—সমস্যার সমাধান বাইরে থেকে আসবে না, তাদের নিজেদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
নিকুঞ্জবাসী কোনো রাজনৈতিক পতাকা তোলেননি, কোনো দলীয় স্লোগান দেননি। তারা রাস্তায় নেমেছিলেন শুধুমাত্র নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য। তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই—হারানো শান্তিকে ফিরিয়ে আনা।
২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল নিকুঞ্জের ইতিহাসে এক বিশেষ দিন। সেদিন নিকুঞ্জবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে ঘোষণা দেন—আর নয়, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এই এলাকায় চলবে না। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে নাগরিক শক্তির সামনে সব বাধা ভেঙে যায়।
এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল এর সাধারণত্ব। কোনো নেতা বা জনপ্রতিনিধি নয়, নেতৃত্বের ভার ছিল সাধারণ মানুষদের হাতে।
গৃহিণীরা যেভাবে রাস্তায় নেমেছেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা যেমন কণ্ঠ মিলিয়েছেন, তরুণ শিক্ষার্থীরা যেমন সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতনতার বার্তা ছড়িয়েছেন—সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছিল এক অনন্য সাধারণ সামাজিক আন্দোলন।
আজ আন্দোলনের পর কেটে গেছে প্রায় পাঁচ মাস। এই সময়ের মধ্যেই পরিবর্তনের দৃশ্য হাতে-কলমে ধরা দিয়েছে।
নির্বিঘ্ন পথচলা: ভিড়ভাট্টা অটোরিকশা নেই, রাস্তায় সুশৃঙ্খল চলাচল এখন স্বাভাবিক নিয়ম। নেই কোন দুর্ঘটনার খবর।
শিশুদের হাসি: সকালবেলা স্কুলমুখী শিশুদের মুখে এখন দুশ্চিন্তার ছাপ নেই, আছে কেবল উচ্ছ্বাস।
শব্দদূষণহীন সকাল: ভোরের কানে তালা লাগানো অটোর সেই হর্ন নেই, আছে পাখির ডাক।
নিরাপদ সন্ধ্যা: কাজ শেষে কিংবা অবসরে মানুষ এখন নিশ্চিন্তে এলাকাতে হাঁটতে বের হন, সাইকেল চালান।
এই ঘটনা প্রমাণ করেছে—কোনো প্রশাসনিক নির্দেশনা ছাড়াই, জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা যে কত বড় পরিবর্তন আনতে পারে, নিকুঞ্জ তার জীবন্ত উদাহরণ। এটি শুধু একটি আবাসিক এলাকার শান্তি ফিরে পাওয়ার গল্প নয়, এটি ঐক্যের শক্তির প্রতিচ্ছবিও।
আজ নিকুঞ্জ একটি প্রতীক—সচেতন নাগরিক চেতনার প্রতীক, সাহসের প্রতীক। সারাদেশের মানুষ যদি নিজেদের সমস্যা সমাধানে এভাবে একজোট হতে পারে, তাহলে প্রশাসনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর না করেও অসংখ্য সংকট সমাধান সম্ভব।
নিকুঞ্জ তাই আজ সারাদেশের জন্য অনুকরণীয় এক মডেল।যেখানে প্রতিবাদ নয়, প্রাধান্য পেয়েছে ইতিবাচক পরিবর্তন; যেখানে ভয় নয়, প্রাধান্য পেয়েছে সাহস; যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ নয়, প্রাধান্য পেয়েছে নাগরিক চেতনা।
লেখক: জাহিদ ইকবাল, সিনিয়র সাংবাদিক ও আহবায়ক, খিলক্ষেত টানপাড়া কল্যাণ সোসাইটি।