দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক শৃঙ্খলার অবসান আমাদের চোখের সামনে ঘটছে। এবং বাংলাদেশ—অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির মতো—পাশ থেকে দেখছে কিভাবে ভূপৃষ্ঠে প্লেট সরানোর মতো এক বিশাল রূপান্তর বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে নতুনভাবে গড়ে তুলছে। যখন জাহিদ হোসেনের মতো বিশ্লেষক অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান চুপচাপ জানায় যে সোনার রিজার্ভ বাড়ছে, আর একদিকে পশ্চিমা আর্থিক যন্ত্র—যেমন ইউএস ট্রেজারি—প্রতি আস্থা কমছে, তখন এটা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং একটি গভীর বার্তা: ডলার-কেন্দ্রিক ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস ক্ষয়ে যাচ্ছে—ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবে—এই বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থায়।
চিত্রটা একবার কল্পনা করুন। বর্তমানে প্রচলিত সব মার্কিন ডলারের ৬০%-এর বেশি ছাপা হয়েছে মাত্র গত পাঁচ বছরে, প্রধানত কোভিডের সময়। যখনই কোনো বৈশ্বিক সংকট আসে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় অর্থনীতিগুলো একটি অজুহাত দাঁড় করায়—নতুন টাকা ছাপা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্সশিট ফুলিয়ে তোলার জন্য। যখন বিশ্বজুড়ে রিজার্ভ কারেন্সি জারিকারী দেশ এতটা আক্রমণাত্মকভাবে ব্যালান্সশিট বাড়ায় এবং একইসঙ্গে এই মুদ্রাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে (যেমন নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে), তখন স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের নজর পড়ে হার্ড অ্যাসেটের দিকে। ২০০০ সালে সোনা যেখানে ২০০ ডলারের মতো ছিল, আজ তা একটি “স্টোর-অফ-ভ্যালু” হিসেবে অবস্থান নিয়েছে এবং বারবার নতুন উচ্চতা ছুঁচ্ছে।
সোনাকে ২০১১ সালের আগস্টের সর্বোচ্চ দামে (নমিনাল দামে) ফিরে আসতে সময় লেগেছে প্রায় ১২ বছর, অর্থনৈতিক মুদ্রার অবমূল্যায়ন বিবেচনায় নিলে এটি বড় ইঙ্গিত। এটা শুধু দামের উর্ধ্বগতি নয়—বরং একটি গভীর বৈশ্বিক পুনর্গঠনের লক্ষণ—ব্রেটন উডস চুক্তির পর এবং নিক্সন প্রশাসনের ডলারের স্বর্ণে রূপান্তর "সাময়িকভাবে স্থগিত"-এর ঘোষণার পরবর্তী যুগে।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর সত্যটি হলো: আমরা এখনো "প্রসেসর" মডেলে আটকে আছি। আমাদের পোশাক কারখানাগুলো প্রতিবছর কোটি কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, কিন্তু প্রকৃত মূল্য তৈরি হয় উর্ধ্বস্রোতে—ব্র্যান্ড, আইপি, আর মূলধনের মালিকানায়। আমরা জারা, এইচঅ্যান্ডএম, নাইকির জন্য সেলাই করি; তারাই লাভের বড় অংশ নেয়, ব্র্যান্ড তৈরি করে, আর গল্প বলে। বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানি করে, অথচ কয়টি বিশ্ববিখ্যাত বাংলাদেশি কনজ্যুমার ব্র্যান্ড আপনি মনে করতে পারেন?
এটাই সেই বিপরীত ধারা—একটি দেশ যেটি লোয়ার-মিডল ইনকাম স্ট্যাটাস অর্জন করেছে, অথচ এখনো এমন নিয়মে খেলছে যা তৈরি করেছে অন্যরা—হোক সেটা যুক্তরাষ্ট্র, চীন কিংবা ভারত। উদ্যোক্তারা ১ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলারের এক্সপোর্ট ডিলে উচ্ছ্বসিত হন, আর সেই পণ্যের ব্র্যান্ড মালিকরা তৈরি করে বিলিয়ন ডলারের রিটেইল ভ্যালুয়েশন। বর্তমান অর্থনৈতিক মডেল কার্যকর হলেও, তা রূপান্তরকারী নয়। ডিজাইন, প্রযুক্তি, আর আইপি-তে না এগোলে আমরা একটি নিম্ন-মার্জিন চক্রে আটকে যাব—যেমনভাবে হ্যামস্টারদের দৌড়ানোর জন্য ট্রেডমিল বানানো হয়।
বাংলাদেশের গড় বয়স এখনো ২৮-এর নিচে, যা আমাদের একটি বিশাল জনমিতিক সুযোগ এনে দেয়। এর মানে, দেশের মোট সম্পদের ৮০%-এর বেশি এখনো তৈরি হয়নি। তবে এই সম্ভাবনা কেবল তখনই কাজে লাগবে, যদি আমরা আমাদের বর্তমান সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করতে পারি। এজন্য শুধু দেশের ভেতরে নয়, বাইরের জগতের দিকেও নজর দিতে হবে। চীনের ইভি সাপ্লাই চেইনের ভাঙন, ২০২৯ সালের ফার্মাসিউটিক্যাল পেটেন্ট ক্লিফ, ও এলডিসি উত্তরণের পর TRIPS চুক্তির বাস্তবতা—সবকিছুই বিশ্ববাজারকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে, আর বাংলাদেশকে সেই গতির সাথে তাল মেলাতে হবে।
জেনারেটিভ এআই-এর উত্থান আরেকটি হুমকি নিয়ে এসেছে: বাংলাদেশ যে ব্যাক-অফিস আউটসোর্সিং ও ছোটখাটো ফ্যাক্টরি জব স্কেল করতে চাইছে, তার বড় অংশই অদূর ভবিষ্যতে স্বয়ংক্রিয় হয়ে পড়তে পারে।
বর্তমান অর্থনৈতিক পথনির্দেশনা—স্বল্প-মূল্যের শ্রম, রপ্তানি-নির্ভর প্রবৃদ্ধি, বিদেশে কর্মরত মূলত অদক্ষ শ্রমিকদের রেমিট্যান্স, নগণ্য আইটি দক্ষতা ও দুর্বল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম—এই মডেলগুলো ধীরে ধীরে তাদের কার্যকারিতা হারাচ্ছে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনো অগভীর, অথচ সেখানে “ফ্রথি” বা ফোলানো ভ্যালুয়েশন লক্ষ্য করা যায়। আমরা এমন একটি ভবিষ্যতের মূল্য দিচ্ছি, যার ভিত্তি এখনো নির্মিত হয়নি।
বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের একাধিক দিক মাথায় রেখে ভাবতে হবে: নিজস্ব আইপি তৈরি, বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনে অন্তর্ভুক্ত হওয়া, এবং দেশের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে প্রযুক্তিনির্ভর পরিষেবা দেওয়া।
বিনিয়োগকারীদের জন্যও বার্তা পরিষ্কার: ডিএসই বা প্রচলিত খাতের বাইরেও নজর দিন। অ্যাসিমেট্রিক বিনিয়োগ—যেমন কৃষি প্রযুক্তি (Agri-tech), আর্থিক প্রযুক্তি (Fintech), বা জলবায়ু সহনশীলতা (Climate Resilience)—গতকালের বিজয়ীদের অনুসরণের চেয়ে ভবিষ্যতে বেশি রিটার্ন দিতে পারে।
প্রশ্নটা এখন আর এই নয় যে পরিবর্তন আসবে কি না।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি সেই নতুন, বহুমুখী, নিম্ন-থেকে-উর্ধ্বমুখী, বৈচিত্র্যময় বিশ্বকে বরণ করে নিচ্ছে? না কি আমাদের নীতিনির্ধারক আর প্রশাসকরা এখনো সেই পুরনো জগত আঁকড়ে ধরে আছেন—যেটি আজ শুধু অতীতের ছায়ায় অস্তগামী সূর্যের মতো ম্লান হয়ে।