বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বেশ টানাপোড়েন চলছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের দুই ধরনের প্রভাব ফেলেছে, দেশটির বেনারসি শাড়ি ব্যবসা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন উত্তর প্রদেশের বারাণসী অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীরা অন্য ধরনের শাড়ি তৈরিতে পেয়েছেন নতুন সুযোগ।
বারাণসীর সরু গলিতে সারাজীবন কাটিয়েছেন ৫৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ আহমেদ আনসারি। এলাকাটি ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী এলাকা হিসেবেও পরিচিত। এই অঞ্চলে কয়েক দশক ধরে বেনারসি শাড়ি বুনছেন আনসারি।
শতাব্দীপ্রাচীন এই নগরের মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ও আজানের সুরের মধ্যে তাঁতের শব্দে মুখর থাকে তার কর্মক্ষেত্র। কিন্তু সম্প্রতি বিক্রি অনেক কমে গেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক উত্তেজনার কারণে।
১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্রতিষ্ঠিত শহরটি ভারতের প্রাচীনতম জনবসতি বলে মনে করা হয় এবং হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্রণের জন্য বেশ পরিচিত ছিল অঞ্চলটি।
গত বছর আগস্টে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দিল্লিতে আশ্রয় নেয়ার পর দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকার হাসিনাকে আশ্রয় দেয়াসহ নানা ইস্যুতে ভারতের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং ভারত থেকে চাল, সুতাসহ কিছু পণ্যের আমদানি সীমিত করে।
পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় চলতি বছরের ১৭ মে ভারতও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের স্থলপথে আমদানি বন্ধ করে দেয়। যদিও বাংলাদেশের শাড়ি এখনও ভারতে রপ্তানি করা যায়, তবে তা করতে হচ্ছে সমুদ্রপথে, যা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।
বেনারসি শাড়ি সূক্ষ্ম কারুশিল্প, বিলাসবহুল সিল্ক, সূক্ষ্ম সোনা ও রূপার তারের সূচিকর্মের সূক্ষ্ম কাজের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত এবং প্রায়শই একটি শাড়ি বুনতে ছয় মাস পর্যন্তও সময় লাগতে পারে। নকশা এবং ব্যবহৃত উপাদানের ওপর নির্ভর করে এগুলোর প্রতিটির দাম এক লাখ রুপি বা তার বেশিও হতে পারে।
বিশেষ করে উৎসব এবং বিবাহের সময় বাংলাদেশে এই শাড়িগুলোর চাহিদা বেশি থাকে। তবে নিষেধাজ্ঞার ফলে এই শাড়ির ব্যবসা ৫০ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পেয়েছে বলে আল জাজিরাকে জানিয়েছেন আনসারি।
আগের ধাক্কাগুলোর সঙ্গেও এই নতুন সংকট যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নোট বাতিলকরণ, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, কোভিড-১৯ মহামারি এবং গুজরাটের সুরাটে উন্নত পাওয়ার লুমে তৈরি শাড়িগুলির সাথে সস্তা প্রতিযোগিতা।
এসব কারণে অঞ্চলটিতে তাঁতিদের সংখ্যা ২ লাখ থেকে অর্ধেকে নেমে এসেছে; অনেকে পেশা বদলে রিকশা চালানোর মতো কাজে যুক্ত হয়েছেন। যদিও ভারতে কৃষিক্ষেত্রের পরেই টেক্সটাইল খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ কাজ করে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ৩৫ লাখের বেশি লোক কাজ করে।
বারাণসীর পাইকারি শাড়ি ব্যবসায়ী ৬১ বছর বয়সী পবন যাদব আল জাজিরাকে বলেছেন, ঢাকার শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের পর থেকে তাদের ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১০ হাজার শাড়ি রপ্তানি করতাম, এখন সব বন্ধ। ১৫ লাখ রুপি পাওনা আটকে আছে ক্লায়েন্টদের কাছে, যা ফেরত পাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব।’
পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের বিপরীত চিত্র
বর্তমানে অস্থিরতা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের শাড়ি ব্যবসায়ীদের জন্য পরিস্থিতি উল্টো আনন্দের। সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশি শাড়ির প্রতিযোগিতায় হারানো বাজার তারা এখন পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে সুতির শাড়ির ব্যবসায়ীদের জন্য একটি নতুন জীবন এনে দিয়েছে, যারা ঢাকার শাড়ির কাছে বাজারের অংশীদারিত্ব হারাচ্ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুরের প্রবীণ ব্যবসায়ী তারক নাথ দাস বলেন, ‘বাংলাদেশি শাড়ি আমাদের বাজারের ৩০ শতাংশ দখল করেছিল, এখন অর্ডার বাড়ছে, দুর্গাপূজার আগে বিক্রি গত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে।’
শান্তিপুর ও পার্শ্ববর্তী হুগলি ও মুর্শিদাবাদ জেলার হাতে বোনা সুতি শাড়ি শুধু দেশীয় বাজারেই নয়, বিদেশেও রপ্তানি হয় গ্রিস, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আসায় স্থানীয় শিল্প আবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। অঞ্চলটিতে এ পেশায় রয়েছেন এক লাখেরও বেশি মানুষ।
ফ্যাশন ডিজাইনার শান্তনু গুহ ঠাকুরতা আল জাজিরাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে সস্তায় নকল শাড়ি আসত। এবার নিষেধাজ্ঞা সঠিক সময়েই এসেছে। এতে দেশীয় শিল্প অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে। এখন ভারতীয় তাঁতি এবং ব্যবসায়ীরা প্রচুর উপকৃত হবেন।’
ভারতের শাড়ি শিল্প বর্তমানে প্রায় ৮০ হাজার কোটি রুপি (৯ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের এবং এটি কৃষির পর দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। বাংলাদেশ-ভারত রাজনৈতিক অস্থিরতা এই শিল্পে নতুন করে চাপ তৈরি করলেও একইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের অনেক ব্যবসায়ীর জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে।
সূত্র: আল জাজিরা
ইএ/টিকে