গোলাম মাওলা রনি

রাজনীতিতে পালানো অপমান নাকি বাস্তবতার নিয়ম—কী বলছে ইতিহাস?

সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি জানিয়েছেন, রাজনীতির শুরু থেকেই একটি দক্ষতা শেখানো হয় আর সেটি হলো কিভাবে নিরাপদে পালাতে হয়। আমরা আজ সেটিকে ‘সেফ এক্সিট’ বলি; অতীতে এটা ছিল পরাজয়ের পর মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে নিরাপদে পিছু হঠার কৌশল। ইতিহাসে আলেকজান্ডারও বহুবার পালিয়েছেন। তাই বর্তমানে যাদের বিরুদ্ধে ‘পালানোর’ অভিযোগ উঠছে, তা কোনো অপমান নয় বরং রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ।

আওয়ামী লীগ শাসনকালে আমি অন্তত আট থেকে দশবার ‘কখন পালাবেন, কিভাবে পালাবেন, কেন পালাবেন’ এমন শিরোনামে বিস্তারিত কলাম লিখেছি। আমি জানতাম, একদিন পালাতে হবে, সেই বিশ্বাসেই সেই লেখা হয়েছিল এবং আমার বিশ্বাস, অনেক নেতা সেগুলো পড়েছেন।

রবিবার (১২ অক্টোবর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে সেফ এক্সিট প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

গোলাম মাওলা রনি বলেছেন, যেদিন থেকে রাজনীতি শুরু সেদিন থেকেই রাজনীতিবিদ, রাজা, মন্ত্রী ও সেনাপতিদের শিখতে হয়েছে কিভাবে পালাতে হয়? নিরাপদে, নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায়।

এখন যেটিকে আমরা ‘সেফ এক্সিট’ বলি, অতীতে সেটিই ছিল নিরাপদে সরে যাওয়ার কৌশল। যুদ্ধের ময়দানে জয়লাভ করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি পরাজয়ের পর সর্বনিম্ন ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে নিরাপদে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে ভবিষ্যতে নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করা এটিও ছিল এক ধরনের কৌশল। রাষ্ট্রীয়ভাবে, রাজনৈতিকভাবেও এই কৌশল শেখানো হতো যেন পরাজয়ের পরও কেউ অন্তত নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকতে পারে।

তিনি বলেন, এক অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।

এরপর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতারা প্লেনে, হেলিকপ্টারে, নৌকায় করে কিংবা পাহাড়, সমুদ্র ও বনভূমি পেরিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। আজ ভারতে, নেপালে, ভুটানে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই আওয়ামী লীগের লোকজন গিজগিজ করছে। পালানোর ব্যাপারে তাদের এক ধরনের বিশাল প্রস্তুতি ছিল।

গোলাম মাওলা রনি বলেন, এখন ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে তুমুল বিতর্ক। এক গ্রুপ বলছে তারা পালিয়ে যাবে; অন্যরা বলছে তারা কখনো পালাবে না এ দেশেই থাকবে।
ওবায়দুল কাদের ও শেখ হাসিনাও একই কথা বলেছেন। রাজনৈতিক চরিত্রদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস হলো তারা কথা দিলে রাখতে পারে না, আর রাজনীতিতে কোনো চূড়ান্ত কথা নেই। এখন যারা ক্ষমতায় আছেন তারা সরাসরি রাজনীতিক নাও হতে পারেন, তবুও পলিটিক্যাল চেয়ারে বসার ফলে তাদের পরিণতি, নিয়তি ও কার্যকলাপই রাজনীতিবিদদের মতো হবে।

ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির মাস্টারমাইন্ড এনসিপি নেতা সারজিস আলম বলেছেন তাদের ‘সেফ এক্সিট’ নেই, তাদের একমাত্র সেফ এক্সিট হবে মৃত্যু।

অন্যদিকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, কিছু উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এবং পালানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন অর্থাৎ ‘সেফ এক্সিট’ বলতে সরাসরি পালানোর চেষ্টা বোঝায়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে উপদেষ্টাদের মধ্যে মতপার্থক্য আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমি এদেশ ছেড়ে যাব না। আমি এখানেই থাকব, আমি পালাব না, কোনো সেফ এক্সিটও নেব না। তিনি আরো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন নাহিদ ইসলামকে ‘আপনি পরিষ্কারভাবে বলুন, কোন কোন উপদেষ্টা সেফ এক্সিট নিতে চাইছেন?’

গোলাম মাওলা রনি বলেন, পালানোর যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সেখানে সবাই পালায়। পৃথিবীর এমন কোনো বীর নেই যে জীবনে একটিবারের জন্য পালায়নি। স্বয়ং আলেকজান্ডার বহুবার পালিয়েছেন। এখন যাদের বিরুদ্ধে পালানোর কথা বলা হচ্ছে বা যাদের সম্পর্কে পালানোর কথা বলছে এটা অসম্মানের কিছু নয়। সবাইকেই পালাতে হয়। ক্ষমতা এমন একটা জিনিস। এটা ভালো করলেও পালাতে হয়, মন্দ করলেও পালাতে হয়।

রনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগের যেসব মন্ত্রী-এমপি যারা সিক্রেট সার্ভিসের বাইরে ছিলেন তারা কিন্তু পালাতে পারেননি, তারা গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু যারা সিক্রেট সার্ভিসে ছিলেন তারা কিন্তু সবাই নিরাপদে দেশের বাইরে চলে গেছেন। আমরা টেরও পাইনি। আমরা শুধুমাত্র শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে উঠেছেন, এই দৃশ্য দেখে লাফালাফি করেছি। কিন্তু শত শত মানুষকে এই সিক্রেট সার্ভিসের আন্ডারে পালানোর যে ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেদ নকশা রয়েছে যেটিকে সেফ এক্সিট বলা হয়। সেই অনুযায়ী তাদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা আগামীতেও হবে, এটাই রাষ্ট্রের নিয়ম।

তিনি বলেন, কাদের ভাগ্যে সেফ এক্সিট আছে আর কাদের ভাগ্যে সেফ এক্সিট নেই, এটা একমাত্র আল্লাহ জানে। অনেকেই এক্সিট নিয়ে রাজার হালে সুন্দরভাবে চলে যাবেন। আবার অনেকেই জনগণের কিল-ঘুষি খেয়ে দাঁত ভাঙবেন, এটাই বাস্তবতা। সময়ই বলে দেবে কার ভাগ্যে সেফ এক্সিট রয়েছে।

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
পাঞ্জাবে ম্যাচ চলাকালে খেলোয়াড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা Dec 18, 2025
img
আবারও চোট শুভমানের, বিশ্বকাপের আগে নতুন উদ্বেগ ভারতের Dec 18, 2025
img
চট্টগ্রামের আলোচিত 'সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ ও তার স্ত্রীর জামিন স্থগিত Dec 18, 2025
img
বিশ্ববাজারে আবারও বাড়ল স্বর্ণের দাম Dec 18, 2025
img
এমবাপের জোড়া গোলে তালাভেরাকে হারিয়ে শেষ ষোলোয় রিয়াল মাদ্রিদ Dec 18, 2025
img
মুস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিং, রোমাঞ্চকর ম্যাচে তবুও হার দুবাই ক্যাপিটালসের Dec 18, 2025
img
টাইব্রেকারে ফ্লামেঙ্গোকে ২-১ গোলে হারিয়ে গ্লোবাল চ্যাম্পিয়ন পিএসজি Dec 18, 2025
img
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করলে দেশের জনগণ তাদের ক্ষমা করবে না : ইশরাক Dec 18, 2025
img
চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নাহিদ গ্রেপ্তার Dec 18, 2025
img
নিজের প্রতি বিশ্বাসই হলো সবচেয়ে বড় ঢাল: রাণী মুখার্জি Dec 18, 2025
img
তারেক রহমানের ফ্লাইটে দেশে ফিরতে নেতাকর্মীদের হিড়িক, শেষ সব টিকিট Dec 18, 2025
img
নতুন লুকে ভক্তদের চমকে দিলেন মেগাস্টার শাকিব খান Dec 18, 2025
img
মেসির ভিডিওতে উজ্জ্বল কারিনার ছবি, কাকে ধন্যবাদ জানালেন বেবো? Dec 18, 2025
img
‘হাওয়া’র চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ ‘রইদ’, ৬ মাস চুলে শ্যাম্পু দেননি তুষি! Dec 18, 2025
img
অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২, ২৪ ঘণ্টায় ডিএমপির হাতে গ্রেপ্তার ৩৯২ Dec 18, 2025
img
ইউরোপের নেতাদের ‘ছোট শূকর’ হিসেবে অভিহিত করলেন পুতিন Dec 18, 2025
img
দেশব্যাপী অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২ অভিযানে একদিনে আটক ১৩৯৮ Dec 18, 2025
img
ওসমান হাদির চিকিৎসা আপাতত সিঙ্গাপুরেই চলবে: ডা. আহাদ   Dec 18, 2025
img
জামিন বাণিজ্যে যারা লিপ্ত আছেন, তাদেরকে বলছি এবার থামুন: আসিফ নজরুল Dec 18, 2025
img
ওসমান হাদির মৃত্যুর সংবাদ সত্য নয়: ইনকিলাব মঞ্চ Dec 18, 2025