ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে চিফ প্রসিকিউটর

রক্ত-মগজের উত্তাপ হাতে না লাগলে অপরাধীদের ফিলিং আসত না

দীর্ঘ সাক্ষ্যগ্রহণ-জেরা শেষে চলছে শেখ হাসিনার বিচারের শেষ ধাপ। শুরু হয়েছে যুক্তিতর্ক। প্রথম দিনেই আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলের ভয়াবহ সব ফিরিস্তি তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তদন্তে পাওয়া তৎকালীন সরকারের সময়ে ক্রসফায়ার তথা বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে নানা হত্যাকাণ্ডের বীভৎস বর্ণনাও দেন তিনি। তেমনই একটি ঘটনা মিরপুরের।

জুলাই গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য ছিল রোববার (১২ অক্টোবর)। এদিন দুপুর পৌনে ১২টা থেকে বিকেল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক চলে। রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর।

একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনালকে তাজুল ইসলাম বলেন, তিন জনকে ধরে নিয়ে যায় র‌্যাব। তাদের মিরপুরের বেড়িবাঁধের দিকে নিয়ে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে একজনকে প্রথমে সড়কে দাঁড় করিয়ে মাথায় গুলি চালান তারা। এতে তিনি পড়ে যান। আবার কিছুদূর যাওয়ার পর দ্বিতীয়জনকে গুলি করা হয়। তবে তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল ছিল। এজন্য গুলি করতেই আগুন ধরে যায় চুলে। ওই সময় হাসাহাসি করতে থাকেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলাবলি করেন, ‘আরে দেখছিস গুলি করলাম, হারামজাদার চুলের মধ্যে আগুন ধরে গেল’। এরপর তাকে ফেলে রেখে আরেকজনকে গুলি করা হয়। তারা পাখির মতো মারত। এসব তাদের কাছে কোনো বিষয় মনে হতো না। উল্টো গুলি করার পর হু হু করে হাসত।

কিছু অপরাধীর বর্ণনা তুলে তিনি বলেন, আমরা বহু তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি। যেখানে অনেক মানুষকে তারা এক ধরনের সিডেটিভ পুশ করতেন। অর্থাৎ মাথায় জমটুপি পরিয়ে ও চোখ-মুখ বাঁধার পরই এ কাজটি করা হতো। যেন ভুক্তভোগীরা কোনো প্রতিরোধ করতে না পারেন। ফলে গুলি করে মারা হলেও লোকটা অনেকটা জড়বস্তুর মতো আচরণ করতেন। প্রতিরোধের চেষ্টা বা চিৎকার করতেন না। কারণ তাকে এমন কিছু করা হতো যে তার এই ক্ষমতাটাই আর থাকত না। এ ছাড়া মাথায় গুলি করলে মগজ আর রক্ত ছিটিয়ে এসে সংশ্লিষ্টদের হাতে লাগত। প্রথমদিকে হাতে এক ধরনের মোজা ব্যবহার করতেন তারা, যেন এসব না লাগে। একপর্যায়ে তা তাদের নেশা হয়ে যায়। রক্ত-মগজের উত্তাপ হাতে না লাগলে আর ফিলিং আসত না। তখন খালি হাতেই এটা করত।

চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, অপরাধী যখন নদীগুলোতে গিয়ে ক্রসফায়ারে মানুষ মারত, তখন প্রথমে গাড়িতে করে নদী পর্যন্ত নিয়ে যেত। সেখান থেকে মানুষজন সরিয়ে রাতের আঁধারে সেসব মানুষকে ট্রলারে ওঠানো হতো। এরপর খোলের মধ্যে রাখত। এজন্য তারা জোয়ার-ভাটার সময় হিসাব করত। একপর্যায়ে গুলিতে একটা একটা করে মেরে ফেলে দিত। ফেলে দেওয়ার আগে পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করত। পরে সিমেন্টের বস্তা বেঁধে ফেলে দেওয়া হতো।

‘মাথায় কেন গুলি করা হতো- এমন প্রশ্নের জবাবে অপরাধী বলেছেন যে, মাথায় গুলি না করলে মরতে দেরি হতো। আমাদের এত সময় নেই, মাথায় দিলে তাৎক্ষণিক মারা যেত। মাথায় গুলি করার আগে মাঝখানে একটা বালিশ রাখতো যেন মগজ ও রক্ত ছিটে মুখে না আসে।

গুম-নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, যতদিন খুশি তাদের গোপন কারাগারে বন্দি রাখত। এরপর বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন না মনে করলে মেরে ফেলা হতো। এটাকে তারা বলত ‘জি করা বা গলফ করে দেওয়া’। একপর্যায়ে গোপনে নদী-নালা, খালবিলে মেরে ফেলে দিয়ে আসত। কখনো লাশ পাওয়া যেত আবার কখনো পাওয়া যেত না পরিচয়ও। অজ্ঞাত লাশ হিসেবে আবিষ্কৃত হতো রেললাইনের পাশে। কেননা, রেললাইনের ওপর ইনজেকশন পুশ করে হত্যা করা হতো। কমলাপুর-টঙ্গী রেললাইনটি বেশি ব্যবহার করা হতো। লাশটাকে রেললাইনের ওপর শুয়ে রেখে তারা দাঁড়িয়ে থাকত ট্রেনের অপেক্ষায়। পরে ট্রেন এলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। চেনার কোনো উপায় থাকত না। এরপর অপরাধীরা চলে আসতেন। রেললাইনের ধারে ট্রেনে কাটা পড়া লাশ। একদিনে তিনটা, চারটা, পাঁচটা লাশ পাওয়া যেত; এমন বহু খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখেছি।
এ দিন শেখ হাসিনার মামলার বিচারকাজ সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করতে সাইবার হামলা করা হয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে এমনটিই জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল। ঠিক ওই সময় আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের ফেসবুক পেজের ওপর সাইবার অ্যাটাক করা হয়। এর মাধ্যমে পেজটাকে সাময়িকভাবে ডিজেবল (নিষ্ক্রিয়) করে দিয়েছিল তারা। যদিও উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

তাজুল ইসলাম বলেন, যুক্তিতর্কে বহু তথ্যপ্রমাণসহ তাদের নিষ্ঠুরতার বর্ণনা যেন গোটা দুনিয়াবাসী জানতে না পারে, এই অপরাধীরা তা চায় না। তাদের সহযোগীরাও এটা চায় না। সেজন্যই আমাদের এই ফেসবুক পেজের ওপর সাইবার হামলা চালিয়েছে তারা। দুনিয়াকে এটা জানতে দিতে চায় না যে বিচারটা কতটা ট্রান্সপারেন্ট বা স্বচ্ছ হচ্ছে। তথ্যপ্রমাণগুলো কতটা অকাট্য সেটা তারা বুঝতে দিতে চায় না। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত এটা উদ্ধার করতে পেরেছি। তবে অপরাধ করে যেমন পার পাওয়া যাবে না, অপরাধীকে রক্ষা করারও কোনো চেষ্টা বাংলাদেশে সফল হবে না ইনশাআল্লাহ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও আসামি হিসেবে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তবে রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দিও দিয়েছেন এই আইজিপি। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। মামলার বিচারকার্যের প্রতিদিনই তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এদিকে, যুক্তিতর্ক আজ শেষ না হওয়ায় আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

টিজে/এসএন


Share this news on:

সর্বশেষ

img
নতুন মহাকাশ রকেটের সফল পরীক্ষা চালালো রাশিয়া Oct 13, 2025
img
ডিসেম্বরে শেষ হবে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণকাজ : ডিএসসিসি প্রশাসক Oct 13, 2025
img
রোমে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আইএফএড প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ Oct 13, 2025
img
একসঙ্গে ২০ জিম্মিকে মুক্তি দেবে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী Oct 13, 2025
img

জুলাই সনদ

গণভোটের সময় নিয়ে নিজ অবস্থানে অনড় বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি Oct 13, 2025
img

সড়ক দুর্ঘটনায়

গোপালগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাল ১ Oct 13, 2025
img
মা ইলিশ রক্ষায় এবার হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে বিমান বাহিনী Oct 13, 2025
img
স্পেনের জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে জামায়াত নেতাদের অংশগ্রহণ Oct 13, 2025
img
হাসিনার পক্ষের লোকদের ঘুসের বিনিময়ে পদায়ন করা হচ্ছে : হাসনাত Oct 13, 2025
img
ট্রাম্পের সভাপতিত্বে শান্তি বৈঠক আজ, থাকছেন গুতেরেসও Oct 13, 2025
img
ট্রাম্পের সঙ্গে ফের ফোনালাপ জেলেনস্কির Oct 13, 2025
img
প্রত্যেক উপদেষ্টা আখের গোছানোর কাজ করে রেখেছেন : সামান্তা শারমিন Oct 13, 2025
img
প্রথমবার বাংলাদেশে আসছেন জাকির নায়েক Oct 12, 2025
img

নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ

ভারতকে উড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস গড়া জয় Oct 12, 2025
img
এনসিপি বিপ্লবী নয়, কিংস পার্টির মতো আচরণ করছে : ইশরাক Oct 12, 2025
দীর্ঘ কয়েক বছর পর হাটার রাস্তা পেল ভোলার পাঁচ গ্রামের মানুষ Oct 12, 2025
img
ফেসবুকে রহস্যময় পোস্ট বাপ্পারাজের, উদ্বেগে ভক্তরা! Oct 12, 2025
img
‘প্রথম ম্যাচের ওপর নির্ভর করছে কোয়ালিফাই’ Oct 12, 2025
img
মিরাজ ক্যাপ্টেন ম্যাটেরিয়াল: ফারুক আহমেদ Oct 12, 2025
img
আগামী ৫ দিন দেশের ৩ বিভাগে বজ্র-বৃষ্টির আভাস Oct 12, 2025