সিআইবি এর পূর্ণাঙ্গ নাম ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো। হলো বাংলাদেশ ব্যাংক এর একটি বিশেষ বিভাগ, যা দেশের ব্যাংক এবং ব্যাংক- বহিভূর্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোর ঋণ গ্রহীতা এবং জামিনদাতাদের ঋণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সরবরাহ করে থাকে। সিআইবি ব্যাংক কর্তৃক সংগৃহীত একটি আর্থিক প্রতিবেদন, যা কোনো ঋণ গ্রহীতা / ব্যক্তিগত জামিনদাতাদের ঋণ গ্রহণের ইতিহাস ও পরিশোধের অবস্থা প্রকাশ করে।
এই রিপোর্টের মাধ্যমে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন কোন ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ দেওয়ার পূর্বে ঋণ গ্রহীতা বা জামিনদার থাকলে তাদের পূর্বের ঋণ পরিশোধের অবস্থা পর্যালোচনা করে ক্লীন সিআইবি রিপোর্ট প্রাপ্তির পর নতুন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অনুকুল সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে যার মাধ্যমে খেলাপী ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব । সাধারণত ঋণ গ্রহীতা ও জামিনদার ব্যক্তিরা সরাসরি তাদের সিআইবি রিপোর্ট দেখতে পারে না, তবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলো নতুন ঋণের আবেদনের সময় এই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে।
সিআইবি রিপোর্টের উদ্দেশ্য :
০১.সিআইবি রিপোর্ট এর মূল উদেশ্য হলো ঋণ আবেদনকারী বা যদি জামিনদাতা থাকে তাদের বিদ্যমান ঋণ থাকলে তার পরিশোধের অবস্থা দেখা ।
০২. ঋণ গ্রহীতা এবং জামিনদাতা থাকলে তাদের মোট ঋণের পরিমান কত।
০৩. ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা।
০৪.বিদ্যমান খেলাপী ঋণের ধরন।
০৫. ঋণের শৃংখলা ফিরিয়ে আনা।
০৬ সিআইবি নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতার চরিত্র ৷ বিশ্লেষণে করতে সহায়তা ৷করে থাকে।
০৭. খেলাপী ঋণ হ্রাস করন।
০৮. ঋণ গ্রহীতাদের খেলাপী ঋণ থেকে বিরত রাখা।
০৯. খেলাপী ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করা।
১০. ঋণ গ্রহীতাকে অর্থায়নের প্রক্রিয়া সহজিকরণ।
১১. সিআইবি ঋণ গ্রহীতার ঋণ সংক্রান্ত একটি কেন্দ্রীয় রেকর্ড সংরক্ষণ।
১২. সঠিক ঋণ প্রদানে সহায়তা করা।
১৩. ঋণ প্রদানে সঠিক তথ্য প্রদান ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
১৪. খেলাপী ঋণ নিয়ন্ত্রণ।
১৫.ঋণ ঝুকি হ্রাস করন।
১৬. ঋণ প্রদানে ব্যাংক গুলিকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা।
১৭. এই রিপোর্টের তথ্যের সঠিকতা সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে নিশ্চিক করতে হয়।
প্রকৃত পক্ষে সিআইবি র মুল উদ্দেশ্য হলো এই রিপোর্টের মাধ্যেম একজন ঋণ গ্রহীতার ক্রেডিট হিস্টোরি ( Credit History) স্বচ্ছ থাকে, যা সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতে শৃংখল আনতে সাহায্য করে। সিআইবি রিপোর্টে একজন ব্যক্তির পূর্বের ঋণ পরিশোধের ভালো বা খারাপ রেকর্ড থাকে, যা যাচাই করে ব্যাংক তার বর্তমান ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পায়।
গ্রাহকের আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করতে এবং সুশৃঙ্খল ঋণ বিতরণ নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। সামগ্রিকভাবে, সিআইবি রিপোর্ট আর্থিক খাতে ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা ও শৃংখলা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সিআইবি রিপোর্ট এর গুরুত্ব:
সিআইবি রিপোর্ট ব্যাংকারদের জন্য অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট। এই রিপোর্ট এর মাধ্যমে একজন ব্যাংকার বুঝতে পারে কোন ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ দেওয়া যাবে এবং কোন ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ দেওয়া যাবে না।
কোন ঋণ আবেদনকারীর ক্লিন সিআইবি না থাকলে তার আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। এই রিপোর্ট এর মাধ্যমে ঋণ খেলাপির তথ্য জানা যায়।
খেলাপী ঋণ প্রতিরোধের জন্য সিআইবি রিপোর্টিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা যার ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ অনুমোদন / মুঞ্জুরী করতে সহজ হয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ইদানিংকালে বড় বড় ঋণ গ্রহীতা খেলাপী হওয়া সত্বেও মহামান্য হাইকোর্ট - এ রিট করে stay Order নিয়ে অনন্তকাল অশ্রেণিকৃত থেকে যাচ্ছে। মহামান্য হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ সিআইবিতে রিপোর্ট না করায় খেলাপী ঋনের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক গুলির খেণাপী ঋণের হার প্রায় ৪৫ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলোর খেলাপী ঋণের হার ২০ শতাংশ।
ব্যাংক গুলি খেলাপি ঋণ গ্রহীতাকে খেলাপী ঋণ হিসেবে সিআইবিতে রিপোর্ট করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক আদালত অবমাননায় রিটকারীকে ঋণ খেলাপি হিসাবে রিপোর্ট করছেন না। ফলে এদেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা প্রকৃত খেলাপী হয়েও অশ্রেনিকৃত/ নিয়মিত থেকে যাচ্ছে। এতে করে প্রকৃত ঋণ খেলাপীর চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে না। বড় বড় ঋণ খেলাপি মহামান্য হাইকোর্টে রীট করে অশ্রেণি থাকায় সমাজের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। তারা সংসদ সদস্য, মন্ত্রীও হচ্ছে। সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে দেশের আপামর জনগণ। সমাজের চোখে ঘৃণিত হচ্ছে ব্যাংকার।
ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ (২০২৩ পর্যন্ত সংশোধিত) এর ধারা ৫ (কককক) অনুযায়ী ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণের পরিমান কমাতে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি শনাক্ত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। একজন ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন সহ নতুন ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় আমাদের দেশে খেলাপী ঋণ গ্রহীতারা উত্সাহিত হচ্ছে। ফলে খেলাপী ঋনের হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া খেলাপী ঋণ গ্রহীতারা দেশের ব্যাংক গুলি খালি করে টাকা পয়সা বিদেশে পাচার করে বিদেশে গিয়ে আরাম আয়াসে জীবন যাবন করছে।
এই কালচারগত সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওযায় যা ঋণ খেলাপীদের উৎসাহিত করছে। এতে করে খেলাপী ঋনের পরিমান হ্রাস না পেয়ে বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ব্যাংক গুলি তারল্য সংকটে ভুগছে। এতে করে ব্যবসায়ী উদ্যেক্তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছে না। এর ফলে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ব্যাহত হচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে না।
এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে রাজনৈতিক এবং সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে আমাদের দেশে খেলাপী ঋণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। এই অবস্থার উন্নতি না হলে দেশের খেলাপী ঋণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনিভাবে খেলাপী ঋণ হ্রাসকরণ, খেলাপী ঋণ রোধকরণ সম্ভব নয়। এতে করে খেলাপী ঋণ গ্রহীতারা উৎসাহিত হবে। দেশে দুর্নীতির আধিক্য আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশে শিল্প বিপ্লব বাধাগ্রস্থ হবে এবং শিল্প উন্নত হবে না। সর্বপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এটাই সত্য এবং এটাই বাস্তব অবস্থা।
লেখক- মোঃ আব্দুল কুদ্দুস , জেনারেল ম্যানেজার, সোনালী ব্যাংক পিএলসি।
টিকে/