রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কিনে ভারত বছরে প্রায় ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ায় জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে ভারত।
প্রশ্ন উঠেছে, কঠিন এই ভারসাম্যের খেলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন রুশ তেলের সুবিধা ছাড়বেন, নাকি কূটনৈতিক সম্পর্কের ঝুঁকি নেবেন? শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এমন বিষয়ই সামনে এনেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, চলতি বছরের আগস্টে প্রথম ধাক্কার মুখোমুখি হয় ভারত। রাশিয়া থেকে তেল কেনার শাস্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সেসময় ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
এরপর গত বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অল্প সময়ের মধ্যেই রুশ তেল কেনা বন্ধ করবেন বলে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর পরদিনই রাশিয়া সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানায়, আর অন্যদিকে ভারত ট্রাম্পের মন্তব্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
দিল্লিতে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত ডেনিস আলিপভ বলেন, “রাশিয়ার তেল ভারতীয় অর্থনীতি ও জনগণের কল্যাণের জন্য অত্যন্ত উপকারী”।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জানায়, তেল আমদানি সংক্রান্ত নীতি মূলত “বিশ্ববাজারের অস্থির পরিস্থিতিতে ভারতীয় ভোক্তার স্বার্থ” বিবেচনা করেই নির্ধারণ করা হয়। পরে এক মুখপাত্র আরও বলেন, “মোদি ও ট্রাম্পের মধ্যে গতকাল কোনও আলাপ হয়েছে বলে আমি জানি না।”
ভারত মূলত মস্কোর পুরোনো মিত্র। আর ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান চাপের মাঝে রয়েছে দিল্লি। আর এই চাপের মাঝে ভারতের জ্বালানি নীতি এখন এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা। কিন্তু প্রশ্ন হলো- ভারতের অর্থনীতির জন্য রুশ তেল আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ ভারত গত বছর রুশ ক্রুড তেল কিনেছে ৫২.৭ বিলিয়ন ডলারের, যা দেশটির মোট তেল আমদানির ৩৭ শতাংশ। বাকি তেল এসেছে ইরাক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), নাইজেরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
২০২১-২২ অর্থবছরের আগে ভারতের প্রধান ১০ তেল সরবরাহকারী দেশ ছিল রাশিয়া, ইরাক, সৌদি আরব, ইউএই, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কুয়েত, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া ও ওমান। এর বাইরে আরও ৩১টি দেশ থেকে তুলনামূলক কম পরিমাণে তেল কিনতো ভারত, যেগুলো নির্ভর করতো বৈশ্বিক দামের ওঠানামার ওপর।
অনেকে মনে করেন, ভারত এখন পুরোপুরি রুশ তেলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ২০২৪ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকেও ৭.৭ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি পণ্য আমদানি করেছে, যার মধ্যে ৪.৮ বিলিয়ন ডলারের ক্রুড তেলও রয়েছে। তবুও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের জ্বালানি বাণিজ্যে ৩.২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি রয়ে গেছে বলে জানিয়েছে দিল্লিভিত্তিক থিংক ট্যাংক গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই)।
২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ সালের মধ্যে ভারতের তেল আমদানিতে প্রথম বড় পরিবর্তন আসে। সেসময় ইরান ও ভেনেজুয়েলা থেকে আমদানি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে এই দুই দেশ থেকে আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়ে ভারতের। আর তাদের জায়গা নেয় ইরাক, সৌদি আরব ও ইউএই।
দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ইউক্রেন যুদ্ধের পর। ২০২১-২২ সালে যেখানে রাশিয়া থেকে ভারতে তেল আমদানি ছিল মাত্র ৪ মিলিয়ন টন, ২০২৪-২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ মিলিয়ন টনের বেশি।
পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার দেওয়া ডিসকাউন্ট বা মূল্যছাড় ভারতীয় রিফাইনারিগুলোর কাছে রুশ তেলকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রুশ তেলের গড় ডিসকাউন্ট ছিল ১৪.১ শতাংশ, আর ২০২৩-২৪ সালে ১০.৪ শতাংশ। এতে ভারত বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করেছে, যা দেশটির মোট ক্রুড তেল আমদানির ৩-৪ শতাংশের সমান।
এই সময়ে ইরাক, সৌদি আরব ও ইউএই’র মতো মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহকারীরা তাদের অংশীদারিত্বে ১১ শতাংশ পয়েন্ট হারালেও প্রকৃত আমদানির পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে, কারণ ভারতের মোট আমদানি বেড়ে যায় ১৯৬ মিলিয়ন থেকে ২৪৪ মিলিয়ন টনে।
তবে ক্ষতির মুখে পড়ে অন্যরা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কুয়েত, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া ও ওমান থেকে আমদানি অর্ধেকে নেমে আসে। ৩১টি ছোট সরবরাহকারী দেশের অংশও কমে যায়। অ্যাঙ্গোলা ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কেবল কয়েকটি দেশ এর ব্যতিক্রম।
গবেষক পার্থ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, “রাশিয়া থেকে আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দেশের রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে তা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। অর্থাৎ, রাশিয়ার উত্থান হয়েছে অন্যদের ক্ষতির বিনিময়ে।”
রুশ তেল থেকে ভারতের বার্ষিক সাশ্রয় প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির মোট ৯০০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিলের এক শতাংশেরও কম। তবুও অর্থনৈতিকভাবে তা উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু যদি ভারত রুশ তেল কেনা বন্ধ করে, তাহলে বৈশ্বিক তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী আমদানির খরচ আরও বাড়াবে। পার্থ মুখোপাধ্যায়ের মতে, “রাশিয়ার দেওয়া ডিসকাউন্টে তেল কিনে ভারত তার অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে পেরেছে এবং বিশ্ববাজারকেও কিছুটা ভারসাম্যে রাখতে সহায়তা করেছে।”
তবে তিনি আরও বলেন, চলতি বছরে তেলের দাম ২৭ শতাংশ কমেছে। প্রতি ব্যারেলের দাম ৭৮ ডলার থেকে ৫৯ ডলারে নেমে এসেছে। যা ভারতের রুশ তেল আমদানি বন্ধের সম্ভাব্য প্রভাবের চেয়ে অনেক বড়। অল্প চাহিদা থাকায় অন্যান্য দেশ সহজেই ভারতের জায়গা পূরণ করতে পারবে।
ভারতের সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা ও জিটিআরআই প্রধান অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, “রুশ তেল ভারতের জন্য দামের স্থিতি ও রিফাইনারি-সুবিধা দুটিই দেয়।”
তার ব্যাখ্যা, “ভারতের বেশিরভাগ রিফাইনারি তৈরি হয়েছে ভারী ধরনের ক্রুড প্রক্রিয়াকরণের জন্য, যা রাশিয়ার ইউরালস ব্লেন্ডের মতো। এর পরিবর্তে হালকা মার্কিন শেল তেল ব্যবহার করতে হলে ব্যয়বহুল প্রযুক্তি পরিবর্তন লাগবে, যা ডিজেল ও জেট জ্বালানির উৎপাদনও কমাবে।”
শ্রীবাস্তব বলেন, দিল্লির সামনে এখন দুটি কঠিন পথ- রুশ তেল কিনে যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তির ঝুঁকি নেওয়া, অথবা মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকার দামী তেলের দিকে ঝুঁকে দেশে জ্বালানির দাম বাড়ানো।
অন্যদিকে ওয়াশিংটনও চাপ বাড়াচ্ছে, আর এই পরিস্থিতিতে ভারত দাঁড়িয়ে আছে এক জটিল মোড়ে। পেছনে পড়ে থাকা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যচুক্তিও এখন অনিশ্চিত, আর স্বল্পমেয়াদি লাভের বদলে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি নেওয়ার সিদ্ধান্তই হয়তো নির্ধারণ করবে দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের গতিপথ।
এমকে/এসএন