মতভেদ কাটাতে ড. ইউনূসের এবার নতুন উদ্যোগ : জিল্লুর রহমান

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও উপস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি আবার এক স্পর্শকাতর সময় পার করছে। সামনে নির্বাচন, চারদিকে অবিশ্বাস, আর মাঝখানে রয়েছে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সব পক্ষকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য পথ খুঁজে বের করা জরুরি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ধারাবাহিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংলাপে বসছেন।

বিএনপি, এনসিপি, জামায়াত ইসলামী এবং অন্যান্য দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। সরকার কথার দরজা খোলা রাখতে সচেষ্ট। পাশাপাশি প্রশাসনিক রদবদল, জেলা প্রশাসক নিয়োগের মানদণ্ড এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে আশ্বাসও এসেছে। আস্থার সংকট কাটাতে এই উদ্যোগগুলোকে দ্রুত স্বচ্ছ ও নথিভুক্ত সিদ্ধান্তে রূপ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

বুধবার (২২ অক্টোবর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে জিল্লুর রহমান এসব কথা বলেন।

জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছে, তার মধ্যে মূল দাবি হলো নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে চালানো, বিতর্কিত কর্মকর্তাদের নির্বাচন দায়িত্ব থেকে সরানো এবং প্রশাসনের যোগ্য, নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়ন ও পুলিশের নিয়োগ-প্রদানের ক্ষেত্রে পক্ষপাত বন্ধ করা। এই দাবিগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে দেশের আস্থা পুনঃস্থাপনের প্রশ্ন। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জনপ্রশাসনের রদবদল তার তত্ত্বাবধানে হবে এবং পদায়ন যোগ্যতার ভিত্তিতে করা হবে।
এই প্রতিশ্রুতি তখনই আস্থায় রূপ নেবে, যখন রদবদলের প্রক্রিয়া ও টাইমলাইন প্রকাশ করা হবে। সিদ্ধান্তগুলো অনলাইনে দেখা যাবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো তা যাচাই করতে পারবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বৈঠকের শেষে দেশের মানুষ জানতে চায় দুই ধরনের তথ্য—কোথায় নূন্যতম একমত হয়েছে এবং কোথায় মতভেদ রয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভোটকেন্দ্রে পর্যবেক্ষণের নিয়ম, মিডিয়ার প্রবেশাধিকার, প্রিজাইডিং অফিসার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মোতায়নের মানদণ্ড এবং প্রার্থীদের প্রচারণায় সবার জন্য সমান সুযোগ। এসব বিষয়ে দ্রুত ঘোষণার মাধ্যমে আস্থার মজবুত ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব।

যদি মতানৈক্যের স্থানগুলোতেও খোলা আলোচনার পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। যেমন—জনমত গ্রহণ, বিশেষজ্ঞ মতামত বা সংসদীয় আকারের শুনানি—তাহলে অবিশ্বাস অনেক কমবে। বর্তমানে আইনের শাসনের খবর মানুষের চোখে আটকে যাচ্ছে এবং এই স্বচ্ছতা তা ভাঙতে সাহায্য করবে।’

জিল্লুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মানবতাবিরোধী মামলায় ১৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে হাজির করা হয়েছে। পরে তাদের ক্যান্টনমেন্টে সাবজেলে পাঠানো হয়েছে। এটি একদিকে বার্তা দেয় যে আইনের চোখে সবাই সমান। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হলো, ন্যায্য বিচারের সব মৌলিক মান মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। অভিযুক্তদের আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ, আদালতে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ, আটক অবস্থায় চিকিৎসা এবং সাক্ষী সুরক্ষা—এই সব বিষয় যত নিখুঁতভাবে মানা হবে, বিচারপ্রক্রিয়ার নৈতিক শক্তি তত বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বাহিনী ও রাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে যে গুজব তৈরি হতে পারে, তা প্রশমিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি সরকারি পোর্টালে মামলার অগ্রগতি, আদালতের নির্দেশ এবং সাবজেলের বিধি-বিধান নিয়মিত হালনাগাদ করে, তবে আস্থার ঘাটতি আরো কমবে বলে আশা করা যায়। এ সময়ে পররাষ্ট্রনীতির বার্তা স্পষ্ট রাখা জরুরি। ভারতের সঙ্গে প্রকল্প বাতিলসংক্রান্ত বিভ্রান্তি এড়াতে একটি একক ফ্যাক্টশিট প্রকাশ করা যায়, যেখানে কোনো প্রকল্প চালু, স্থগিত বা বাতিল তা টেবিল ও প্রশ্নোত্তর আকারে দেখানো হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচনের সময় সব পক্ষকে নিরপেক্ষ তথ্য ও সময়সূচি জানানো গুরুত্বপূর্ণ। ভোটাররা কেন্দ্রে কী করবে, প্রশাসন কেন বদলি হয়েছে—এই তথ্য আগে জানালে সন্দেহ কমবে। ভোটের নিরাপত্তা মানে অংশগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। প্রথমবার ভোটদাতা, শহরে আসা গ্রামবাসী বা প্রতিবন্ধকতায় থাকা ভোটার যেন ঝামেলা ছাড়া ভোট দিতে পারে। পাড়া-মহল্লাভিত্তিক সহায়তা ডেস্ক এ ক্ষেত্রে কাজে লাগবে।’

জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী উপস্থিত থাকবে তবে ভয়ের পরিবেশ নয়। ডিজিটাল চ্যালেঞ্জ যেমন ডিপফেক ভিডিও ও ভুয়া বিজ্ঞপ্তি মোকাবেলায় দলগুলোর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ডিজিটাল আচরণবিধি প্রয়োজন। ভুল প্রমাণিত হলে দ্রুত সংশোধন ও যৌথ খণ্ডন হবে। প্রশাসন পদায়ন যোগ্যতার ভিত্তিতে হোক এবং মানদণ্ড প্রকাশযোগ্য ও আপিলযোগ্য হোক। সংলাপ চালু রাখতে শীর্ষ নেতৃত্ব নীতি ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে একমত হবে আর টেকনিক্যাল দল সময়সূচি, চেকলিস্ট ও মাস্টার প্রোস্টার নিয়ে কাজ করবে।’

জিল্লুর রহমান মনে করেন, ‘সরকার বলবে আমরা আস্থা চাই, বিরোধীরা বলবে আমরা সুযোগ চাই, প্রশাসন বলবে আমরা ন্যায্যতা নিশ্চিত করব, নির্বাচন কমিশন বলবে আমরা সমান নিয়মে কাজ করব এবং নিরাপত্তা বাহিনী বলবে আমরা অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা দূর করব। এই পাঁচটি বাক্য যদি বাস্তব পদক্ষেপে রূপান্তরিত হয় তাহলে নতুন করে তত্ত্বের কথা বলার কোনো প্রয়োজন থাকবে না। রাষ্ট্রের শক্তি কেবল ক্ষমতায় নয় বরং আস্থায়। আস্থা আসে কাজ থেকে, কথায় নয়।’

তিনি বলেন, যদি এই পাঁচটি প্রতিশ্রুতি বাস্তব পদক্ষেপে রূপান্তর হয়, তবে সংলাপ চলুক এবং নির্বাচনের ফল স্বচ্ছ ও আস্থাভিত্তিক হবে। পররাষ্ট্র বার্তা একক কণ্ঠে আসুক, ডিজিটাল আচরণে ন্যূনতম যৌথ চুক্তি হোক এবং ভোটের পরে মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারুক। সুরক্ষা, সম্মান ও সৎ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করলেই আস্থার বাতাস বইবে এবং নতুন দিনের রাজনীতি শুরু হবে।

আরপি/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img

প্রধান উপদেষ্টা

শিক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ বিকাশে শিক্ষার পাশাপাশি ক্রীড়া চর্চা অপরিহার্য Oct 23, 2025
শেখ হাসিনার মামলার রায়ের দিন ধার্য হতে পারে বৃহস্পতিবার টাইমস ফ্ল্যাশ Oct 23, 2025
img
মুশফিকুল ফজল আনসারীকে নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস সংগীতশিল্পী ন্যান্সির Oct 23, 2025
img
‘লাইফে টেনশন নেওয়ার কিছু নেই’- জীবনের মন্ত্র জানালেন জ্যাকি শ্রফ Oct 23, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

ফ্রাঙ্কফুর্টকে ৫-১ গোলে বিধ্বস্ত করল লিভারপুল Oct 23, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

বেলিংহ্যামের দুর্দান্ত গোলে জুভেন্টাসকে উড়িয়ে দিল রিয়াল মাদ্রিদ Oct 23, 2025
img
নগর বাউলের তৃতীয় স্ত্রী কে এই মার্কিন তরুণী? Oct 23, 2025
img
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাতে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ২ গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ, আহত ৩০ Oct 23, 2025
img
সেন্টমার্টিন ভ্রমণে নতুন ১২ নির্দেশনা জারি Oct 23, 2025
img
বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের তালিকায় সিলেট! Oct 23, 2025
img

মানবতাবিরোধী অপরাধ

শেখ হাসিনা ও কামালসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে রায়ের তারিখ ধার্য হতে পারে আজ Oct 23, 2025
img
ফ্রি ফায়ার ওয়ার্ল্ড সিরিজ খেলতে জাকার্তায় যাচ্ছে বাংলাদেশ দল! Oct 23, 2025
img
ফেসবুক লাইভে এসে আ.লীগে যোগ দেওয়ার কথা জানালেন বিএনপি নেতা ফজলুর করিম Oct 23, 2025
img
বাড়ল ডলারের দাম ! Oct 23, 2025
img
গরু চুরির মামলায় কারাগারে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা Oct 23, 2025
img
অক্টোবরের ২১ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এলো ১৮৫ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার Oct 23, 2025
img
অবশেষে কমলো রুপার দাম! Oct 23, 2025
img
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাজনৈতিক বাগবিতণ্ডার জেরে ২ গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ Oct 23, 2025
img
গাজীপুরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ৩ ঘণ্টা পর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সচল Oct 23, 2025
img
ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক অনিশ্চিত, ‘অফলপ্রসূ' আলোচনায় রাজি নন ট্রাম্প Oct 23, 2025