দুর্নীতি রুখতে জমির লিজ প্রথা সংস্কার

নাগরিকদের কেনা সম্পত্তি (প্লট, ফ্ল্যাট ও জায়গা) সাধারণত ৯৯ বছরের জন্য লিজ দলিল করা হয়। এই দলিলের শর্ত অনুযায়ী এ সম্পত্তি উত্তরাধিকার, ক্রয়, দান বা হেবা সূত্রে নামজারি; হস্তান্তর ও আম-মোক্তার দলিল দেওয়া বা বাতিল এবং ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়।

এসব হয়রানি, ভোগান্তি ও দুর্নীতি রুখতে এবার সংস্কার হচ্ছে জমির লিজ প্রথা। লিজদাতা প্রতিষ্ঠান, আন্তমন্ত্রণালয় সভার মতামত নিয়ে গঠিত উপকমিটির মতামত অনুযায়ী সংস্কারে আটটি প্রস্তাব করা হয়েছে। যা এরই মধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, সাফ কবালার কথা শুনে সেবাগ্রহীতা বা সম্পত্তি গ্রহীতারা আশাবাদী হয়ে উঠলেও রীতিমতো যেন মাথায় বাজ পড়েছে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে। বিশেষ করে এ চিঠি পেয়ে নড়েচড়ে বসেছেন কর্মচারীরা। কারণ, বেশির ভাগ কর্মচারী অনিয়ম-দুর্নীতি ও ফাইল আটকে রেখে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে কাজ করেন।

সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রায় প্রত্যেক পিয়ন প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক। মূলত সেবাগ্রহীতাদের জিম্মি করে রেখেছে এ দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে যাচাইবাছাই পদ্ধতি বাতিল হলে একজনের প্লট বা ফ্ল্যাটের মালিক অন্যজন সহজে বিক্রি করে দিতে পারে এমন সম্ভাবনাও দেখছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দীর্ঘ মেয়াদে লিজ নেওয়ার পরও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধাপে অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকায় লিজগ্রহীতারা নানাভাবে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

একই সঙ্গে এ ধরনের প্রথা চালু থাকায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে এ ধরনের হয়রানি ও ভোগান্তি বছরের পর বছর চলছে। এ ছাড়া বেসরকারি ভূমি ডেভেলপাররা তাদের সাফ কবালা দলিলে বিক্রীত সম্পত্তি বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে পরবর্তী হস্তান্তরকালে অনুমোদনের নামে ক্রেতাদের হয়রানি করছে। তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। লিজগ্রহীতাদের এ ধরনের হয়রানি ও ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে।

এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ, দপ্তর বা সংস্থার কাছ থেকে লিজগ্রহীতাদের ভোগান্তি ও হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে করণীয় বিষয়ে লিখিত মতামত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট লিজদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত চারটি কমিটির মাধ্যমে আটটি সুপারিশ নেওয়া হয়।

সুপারিশগুলো হলো- লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন গ্রহণের বর্তমান প্রথা কোনো আইন, বিধিমালা বা প্রবিধানমালা দ্বারা সমর্থিত নয়। শুধু লিজগ্রহীতার সঙ্গে করা লিজ দলিলের মধ্যে এসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে। লিজগ্রহীতাদের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি এবং ব্যাপক দুর্নীতি রুখতে এ প্রথা বাতিল করা। তবে লিজ দলিলের অন্যান্য শর্ত যেমন- কোনো একাধিক প্লটের একত্রীকরণের মাধ্যমে আয়তনের পরিবর্তন, প্লট বা ফ্ল্যাটের শ্রেণির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পদ্ধতি থাকবে।

নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত কর্তৃপক্ষগুলোর আয়ের খাত অব্যাহত রাখার জন্য ফ্ল্যাট, জমি ও ভবনসহ ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিলের ২% এবং ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিলের ৩% অর্থ রেজিস্ট্রেশন দলিলের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ, দপ্তর বা সংস্থার অনুকূলে আদায় করা। এ ছাড়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্লট বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে একইভাবে ও পদ্ধতিতে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নন-ট্যাক্স রেভিনিউ (এনটিআর) হিসেবে আদায় করা।

উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো তাদের (উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) আওতাধীন এলাকায় সব ধরনের দলিলের ওপর ১% সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে আদায় করা।

লিজ সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিলের পর অবিকল নকল দলিল ৯০ দিনের মধ্যে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানে জমাদান করতে হবে। অন্যথায় দৈনিক ৫০ টাকা হিসেবে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। একই সঙ্গে গ্রাহক দলিল বা নামজারির কপি লিজদাতা প্রতিষ্ঠানে দেওয়ার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ৩০ দিনের মধ্যে তা হালনাগাদ করতে হবে। অন্যথায় কর্তব্য-কর্মে অবহেলার দায়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রথা অনুযায়ী সাধারণত ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়। এ দীর্ঘ সময় শেষ হওয়ার পর নতুনভাবে এ প্রথা বাতিল করা এবং নামজারি ও হস্তান্তর ফি আদায়ও বাতিল করা।

আবাসিক প্রাতিষ্ঠানিক, বাণিজ্য ও শিল্প প্লট, ফ্ল্যাট বা জমি হস্তান্তর ও নামজারির ক্ষেত্রে লিজদাতা কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন নেওয়ার প্রথা বহাল রাখা। যেসব আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে মালিকানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে সেগুলোর গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে যেসব আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাট জানুয়ারি ২০০৯ থেকে জুলাই ২০২৪ মেয়াদে বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো অনুমোদন গ্রহণ প্রথা বহাল রাখা। তবে মালিকানা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হলে প্লট, ফ্ল্যাট বা বাড়ির নামজারি ও হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রথা বাতিল করা। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বেসরকারি ভূমি ডেভেলপাররা সাফ কবালা দলিলে বিক্রীত ভূমি বা ফ্ল্যাটের হস্তান্তরে বিক্রয় অনুমোদন দেওয়ার নামে ক্রেতাকে হয়রানি থেকে রক্ষা করা এবং তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় বন্ধ করা।

এবি/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
নতুন মামলায় গ্রেপ্তার নজরুল ইসলাম ও আরিফ হাসান Nov 03, 2025
img

ডোনাল্ড ট্রাম্প

আমাদের যথেষ্ট পারমাণবিক অস্ত্র আছে, পৃথিবীকে ১৫০ বার উড়িয়ে দেওয়া যাবে! Nov 03, 2025
img
নির্বাচনে দায়িত্বরতদের ওপর আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের দায়িত্ব এসে পড়েছে: সিইসি Nov 03, 2025
img
নৌকাকে বুকে তোলার বা মাটিতে নামানোর দরকার নেই : মাসুদ কামাল Nov 03, 2025
img
উড়ন্ত গাড়ি আনছে টেসলা; ইলন মাস্কের ইঙ্গিত Nov 03, 2025
img
আর নেই সাবেক মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী Nov 03, 2025
img
অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদ সম্মেলন শুরু Nov 03, 2025
img
রাজধানীতে ঝটিকা মিছিলে আওয়ামী লীগের ৬ নেতাকর্মী আটক Nov 03, 2025
img
ফের বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে পতন Nov 03, 2025
img
বাংলাদেশ এখন সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে : সিইসি Nov 03, 2025
img
প্রধান ইস্যু এখন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন : জাহেদ উর রহমান Nov 03, 2025
img
জিয়াউর রহমানের পর ইউনূস সরকারই সবচেয়ে সফল : ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ Nov 03, 2025
img
বিএনপির ওয়েবসাইটে বড় পরিবর্তন, দেওয়া যাবে অনুদানও Nov 03, 2025
img
জামায়াতের নির্বাচনী ক্যাম্পেইন ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়ে রুমিন ফারহানার মন্তব্য Nov 03, 2025
img
দেশের তিন বিভাগে বজ্রবৃষ্টির আভাস Nov 03, 2025
img
ভোটের বাজারে এনসিপির কোনো অবস্থান নাই : মাসুদ কামাল Nov 03, 2025
img

বিয়ারিং প্যাড পড়েপথচারী নিহতের ঘটনা

জীবনের মূল্য হিসেবে নয়, তাৎক্ষণিক সাহায্য করা হয়েছে : ডিএমটিসিএল এমডি Nov 03, 2025
img
বিসিবির নতুন পরিচালক রুবাবা দৌলা Nov 03, 2025
img
এআই এখন মেটার উদ্বেগের বড় কারণ Nov 03, 2025
img

তাইওয়ান ইস্যুতে ট্রাম্পের কড়া বার্তা

আমি সবার কাছে সব কিছু বলি না, চীন কিছু করলে পরিণতি হবে ভয়াবহ Nov 03, 2025