জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই দিনে হবে। এই গণভোটে জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলোর ওপর বিভিন্ন দলের দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) উল্লেখ থাকবে না। তবে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সনদ বাস্তবায়নে ২৭০ দিনের বাধ্যবাধকতার যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটিও তুলে দেওয়া হবে। এছাড়া পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে গঠিত হবে সংসদের উচ্চকক্ষ। অর্থাৎ জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত উভয় পক্ষের যে দাবি রয়েছে, সেসব দাবি মানার ক্ষেত্রে সরকার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। গত কয়েকদিনের আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনার ভিত্তিতে সরকার এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
             
        
সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভায় উল্লিখিত সব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তবে এখনই এসব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি বিরোধে যেতে চায় না সরকার। এজন্যই দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাতে কমপক্ষে এক সপ্তাহের সময় দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র দেশের একটি গণমাধ্যমকে এসব বিষয় নিশ্চিত করেছে।
এদিকে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন। তিনি জানান, উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ চূড়ান্তকরণ এবং এ ব্যাপারে গণভোট নিয়ে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ ধরনের মতবিরোধ উদ্বেগজনক। এ অবস্থায় গণভোটের সময়, বিষয়বস্তু এবং সনদে উল্লিখিত ভিন্নমতের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে সরকারকে প্রস্তাব দিতে হবে। সম্ভব হলে এক সপ্তাহের মধ্যে জানাতে হবে সিদ্ধান্ত। তা না হলে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
বৈঠকের একাধিক সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে সরকারের পক্ষ থেকে সোমবার যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সেখানেই গণভোটের ব্যাপারে বার্তা রয়েছে। এর ব্যাখ্যা করে বলা হয়, সরকার ৩ নভেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোকে সময়সীমা দিয়েছে। এক্ষেত্রে অনুরোধ করা হয়েছে এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে। কিন্তু সরকার ধারণা করছে, এ সময়ের মধ্যে হয়তো পারবে না। এতে আরও দুই-তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে। দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তারা এ ধরনের বার্তা পেয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় নভেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময় লাগবে। এরপরও তারা একমতে আসতে না পারলে সরকার আদেশ জারি করবে। এছাড়াও গণভোটসহ সনদ সংক্রান্ত অন্য সিদ্ধান্তগুলো জানাবে সরকার। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর দাবি-নভেম্বরের মধ্যে গণভোট করতে হবে। ফলে এ সময়ের মধ্যে গণভোট করা অসম্ভব। আবার ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। আর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট সম্ভব নয়। এ কারণে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে করতে হবে গণভোট। এছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর দাবিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ, বিএনপির অন্যতম দাবি ছিল জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট। আবার জামায়াতে ইসলামীর দাবি পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন। এটিও মানা হচ্ছে। এছাড়া সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশে কিছু বিষয়ের সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। যেমন নির্বাচিত সংসদ (সংবিধান সংস্কার পরিষদ) ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে জুলাই আদেশের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে তা প্রতিস্থাপিত হবে। সরকার এই বাধ্যবাধকতা রাখতে চাচ্ছে না। এটি বিএনপিরও দাবি। অন্যদিকে সনদের যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট আছে, গণভোটে সেগুলো বাদ দেওয়া হবে। এটি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবি। নির্বাচনের পর যে দল ক্ষমতায় যাবে, তারা গণভোটে পাশ হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে, না করলে জনগণ তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। সূত্র আরও জানায়, সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার সরাসরি বিরোধে জড়াতে চাচ্ছে না। কারণ, কোনো দল গণভোটের বিপক্ষে ক্যাম্পেইন করুক, সেটি কাম্য নয়। দ্বিতীয়ত, গণভোট যেহেতু সাধারণ মানুষ দেবে, তাই মানুষকে বোঝানো জরুরি-সরকার ঐকমত্যের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। 
সংবাদ সম্মেলনে আসিফ নজরুল বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ চূড়ান্তকরণ এবং এতে উল্লিখিত গণভোট আয়োজন ও গণভোটের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হয়। ঐকমত্য কমিশনে দীর্ঘদিন আলোচনার পরও কয়েকটি সংস্কারের সুপারিশ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। এছাড়া গণভোটের সময় ও বিষয়বস্তু কী হবে-এসব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এটি উদ্বেগজনক। এ অবস্থায় গণভোটের সময়, বিষয়বস্তু এবং সনদে উল্লিখিত ভিন্নমতের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে-তা নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো স্বীয় উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে সরকারকে প্রস্তাব দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সম্ভব হলে এক সপ্তাহের মধ্যে এই পরামর্শ দিতে হবে। এতে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ হবে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়াও সভায় ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, এ সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্তে আসতে না পারলে সরকার সিদ্ধান্ত দেবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, ইতোমধ্যে একটি দল আলোচনার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। ফলে আমরা চাই আলোচনার মাধ্যমে তারা সমস্যার সমাধান করুক। 
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্র সংস্কারে জুলাই সনদে ৮৪টি প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে বেশকিছু প্রস্তাবে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। সংবিধান সংশোধনে রয়েছে ৪৮টি প্রস্তাব। এ পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াতসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এরপর ২৮ অক্টোবর সনদ বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ করেছে ঐকমত্য কমিশন। সুপারিশ অনুসারে প্রস্তাবগুলো তিন ভাগে বাস্তবায়ন হবে। ৯টি নির্বাহী আদেশে, ২৭টি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এবং সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাব গণভোটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। এছাড়াও পরবর্তী সংসদ দুটি দায়িত্ব পালন করবে। প্রথমত, সংবিধান সংস্কার পরিষদ। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত আইনসভা। সুপারিশে আরও বলা হয়, আগামী সংসদে নির্বাচিত সদস্যরা প্রথম অধিবেশন শুরুর ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধান সংশোধন করবেন। এই সময়ের মধ্যে তারা সংবিধান সংশোধনে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলো সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হবে। এরপর ৪৫ দিনের মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এক্ষেত্রে কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট আমলে নেওয়া হয়নি। সুপারিশে আরও বলা হয়, সনদ বাস্তবায়নে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ভিত্তি ধরে সরকার একটি আদেশ জারি করবে। আদেশের নাম হবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’। এই আদেশের ওপর হবে গণভোট। এই সুপারিশ জমা দেওয়ার পরপরই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি শুরু হয়। জামায়াত ও এনসিপি অধিকাংশ সুপারিশের পক্ষে। কিন্তু বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বিএনপি।
টিকে/