বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল বিমান চলাচল খাতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সরাসরি কূটনৈতিক উদ্যোগ শুরু করেছে ইউরোপের শীর্ষ বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চার কূটনীতিক সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, বাংলাদেশ যেন তারা ইউরোপীয় কম্পানিগুলোর জন্য একটি সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করে। বিশেষ করে বিমান চলাচল খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত খাতগুলোতে।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় ফ্রান্স-জার্মানির দূতাবাসে অনুষ্ঠিত ‘ইউরোপিয়ান ডায়ালগ অন বাংলাদেশের অ্যাভিয়েশন গ্রোথ’ শীর্ষক এক আলোচনাসভায় প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধিদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন ইউরোপের চার প্রভাবশালী কূটনীতিক—ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জ্যঁ-মার্ক সেরে-শার্লে, জার্মানির রাষ্ট্রদূত ড. রুডিগার লটজ, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার।
অনুষ্ঠানটির মূল আয়োজন ছিল এয়ারবাসের। তবে চার রাষ্ট্রদূতের অংশগ্রহণে এটি শুধু শিল্প আলোচনা নয়, বরং এক ধরনের কূটনৈতিক লবিং, যা ইঙ্গিত দেয়, বাংলাদেশ বিমানের বহর সম্প্রসারণে ইউরোপ এখন সরাসরি ভূমিকা রাখতে চায়।
ইউরোপের চার দেশের রাষ্ট্রদূত বলেন, তাঁরা বাংলাদেশের বৃহত্তর বিমান চলাচল ইকোসিস্টেমকে সমর্থন করার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারি গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁরা ব্যাখ্যা করেন, এর মধ্যে থাকবে পাইলট ও প্রকৌশলী প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম এবং শিল্প দক্ষতার স্থানান্তর, যার সবকিছুর লক্ষ্য হলো বিমানের পরিচালন সক্ষমতা জোরদার করা এবং স্থানীয় মানব পুঁজির বিকাশ ঘটানো।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কাছে এয়ারবাস কর্তৃপক্ষ ১৪টি উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১০টি এয়ারবাস এ-৩৫০ এবং চারটি এয়ারবাস এ-৩২০নিও।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক শুল্ক সমন্বয় করতে বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে বিমানের কাছে ১৪টি প্লেন বিক্রির প্রস্তাব দিয়েও রেখেছে মার্কিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করছে।
তবে আকর্ষণীয় প্রস্তাবের সঙ্গে এবার কূটনৈতিকভাবেও দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে এয়ারবাস। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, তাদের প্রতিযোগীর চেয়ে এয়ারবাসের উড়োজাহাজ জ্বালানি সাশ্রয়ী ও টেকসই। তারা বিমানের কাছে উড়োজাহাজ ক্রয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চায়।
অনুষ্ঠানে ঢাকায় অবস্থিত ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা বলেছেন, বিমানের বর্তমান বহরের পাশাপাশি এয়ারবাসের উড়োজাহাজ যুক্ত হলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নমনীয়তা, স্থিতিশীলতা ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা আরো বাড়বে।
ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জ্যঁ-মার্ক সেরে-শার্লে বলেন, ‘ফ্রান্স ও ইউরোপের বিমান শিল্পের কেন্দ্রে অবস্থান করছে এয়ারবাস।
প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও উদ্ভাবনের অনন্য সমন্বয়ই এয়ারবাসকে ইউরোপীয় শিল্পগৌরবের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং একই সঙ্গে এটি বিশ্বজুড়ে বিমান সংস্থাগুলোর এক বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। এই কারণেই আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের বিমান খাতের এই গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ পর্বে এয়ারবাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে।’
ঢাকায় জার্মানির রাষ্ট্রদূত রুডিগার লটজ বলেন, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্প্রসারণের ফলে বিমানের এখন প্রয়োজন আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব উড়োজাহাজ, যা সরবরাহে এয়ারবাস অত্যন্ত ভালো অবস্থানে রয়েছে।
ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারা কুক বলেন, যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আঞ্চলিক বিমান পরিবহন হাব হওয়ার লক্ষ্যে অবিচল সমর্থন দিয়ে যাবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বাণিজ্যিক অংশীদারিকে আরো জোরদার করার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রদূত মিলার ইইউ এবং বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের বিবর্তনকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আধুনিকীকরণ এবং বহুমুখীকরণের জন্য ইইউ দীর্ঘকাল ধরে সহযোগিতা করে আসছে। বাংলাদেশের পোশাকের বড় বাজার ইউরোপ, সেখানে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত এয়ারবাসের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের বিমান খাতের সম্ভাবনা তুলে ধরেন এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও সরকারের সঙ্গে তাঁদের চলমান সম্পৃক্ততা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে এয়ারবাসের কমার্শিয়াল সেলস ডিরেক্টর (চিফ রিপ্রেজেন্টেটিভ বাংলাদেশ) রাফায়েল গোমেজ নয়া বলেন, বিশ্বে ৪০টির বেশি দেশে এয়ারবাস দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
প্রতিষ্ঠানটি এযাবৎকালে ২৫ হাজার ১২৯টি এয়ারক্রাফট বিক্রি করেছে, যার মধ্যে ১৬ হাজার ৪৭০টি এরই মধ্যে ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোতে পরিচালিত ফ্লাইটের ৭২ শতাংশ এয়ারক্রাফট এয়ারবাস প্রতিষ্ঠানের।
এ ছাড়া অন্যান্য বিমান থেকে এয়ারবাসের পরিচালন খরচ ২০ শতাংশ কম। বাংলাদেশে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস সফলতার সঙ্গে তিনটি এয়ারবাস ব্যবহার করছে। আশা করছি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসও নিজেদের বহরের জন্য এয়ারবাসকে নির্বাচিত করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।
এমকে/এসএন